বিশেষ প্রতিবেদন: নির্বাচনের গমগমে আওয়াজ যেখানে শান্ত হয়ে আসে সেখানে তাঁদের জীবন শুরু হয়। হাজার হাজার নারী। তাদের একমাত্র পরিচয়—বৃন্দাবনের বিধবা। তুমুল হইহট্টোগোল ও কলরবের মধ্যেও তারা পরিত্যক্ত, নীরব। বিশেষ করে দেশে যখন লোকসভা নির্বাচন চলছে তখন তাঁদের নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই।
তাঁদের অনেকের ভোটাই পরিচয়পত্রই নেই। অধিকাংশ নারীর বয়স এখন ৬০ বা ৭০-এর কোঠায়। পরিবার কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়ে তাঁরা এই মন্দির শহরের আনাচে কানাচে আশ্রয় নিয়েছেন। ভার্চুয়ালি তাঁদের কোনও আত্মপরিচয় অবশিষ্ট নেই। এঁদের সবার মাথায় একটাই তকমা আর তা হল, তাঁদের স্বামীরা মারা গেছেন। এঁরা এমনই এক ছিন্নমূল নারী গোষ্ঠী।
তাঁদের ঠাঁই ভিড়ে ঠাসা নোংরা ঘরে। সেখানে তাঁরা মানবেতর জীবনযাপন করেন। সারাদিনে উপার্জন মাত্র ২০-২৫ টাকা। কিংবা এর চেয়েও কম। ভজন গেয়ে জীবন কাটান তাঁরা। এই নির্বাচনের মরসুমে সবার জন্য অনেক প্রতিশ্রুতি, কিন্তু তাঁদের জন্য কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতিশ্রুতি নেই। এঁদের অধিকাংশই নিজেদের জীবন ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকে এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
গায়ত্রী মুখার্জির কথাই ধরা যাক। তিনি দুঃখ করে বলেন, ভারতের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও তাঁর ভোটাধিকার নেই। মুখার্জি তাঁর স্বামীকে হারিয়েছেন। তাঁর একমাত্র কন্যা কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তাঁদের চিকিৎসার জন্য নেওয়া ঋণ শোধ করার পর তিনি বৃন্দাবনে চলে এসেছেন। তাঁর কথায়, “যখন কলকাতায় ছিলাম তখন প্রতিটি নির্বাচনে আমি ভোট দিতাম। আমি এই দেশের একজন নাগরিক এবং আমার মনে হয়, গণতন্ত্রের এই মহোৎসবে আমারও অংশগ্রহণ করা উচিত। তা হয়ত আর সম্ভব নয়। তাই দুঃখ করে কী লাভ!” অথচ গায়ত্রী মুখার্জি রাজনৈতিক ভাবে ভীষণ সচেতন।
অনিতা দাস। তিনিও পরিবার কর্তৃক পরিত্যক্তা। নির্বাচনের খবর তিনিও রাখেন, কিন্তু উদাসীন ভাবে তিনি মেনে নিয়েছেন যে, তাঁদের মতো নারীদের জন্য এই নির্বাচনের কোনও অর্থ নেই। এক মন্দিরে গান গাইতে যাওয়ার সময় পিটিআই-কে তিনি বলেন, “আমার বয়স এখন ৮০।
আমি চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু এই বয়সে এসে ভোটার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েও আমি কী করব? দরজায় দরজায় না ঘুরে বরং জীবনের শেষ কটা দিন কৃষ্ণের নাম জপ করতে করতে কাটিয়ে দেওয়াই ভাল।” তিনি আরও বলেন, “আমি জানি নির্বাচন চলছে। পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতিও গুরুতর, কিন্তু আমি এখানে শান্তিতে বাস করতে চাই। ভোটার কার্ড হওয়া বা ভোট দেওয়া নিয়ে আর তেমন কোনও আগ্রহ নেই।” ১৭ বছর আগে স্বামীর মৃত্যুর পর অনিতা দাস কলকাতা থেকে বৃন্দাবনে চলে এসেছিলেন। বিধবাজীবনের অধিকাংশ সময়ই তাঁর কেটে গেছে বৃন্দাবনের অলিতে গলিতে। মথুরা লোকসভা আসনের অন্তর্গত বৃন্দাবন।
স্বামীর মৃত্যুর পর নিজগৃহে পরবাসী হয়ে থাকতে না পেরে ১৫ বছর আগে এখানে চলে এসেছিলেন মহানন্দা। তাঁর পুত্রবধূর অত্যাচারে তিনি বৃন্দাবনে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি বলেন, “আমার আধার কার্ড রয়েছে কিন্তু ভোটার পরিচয় পত্র নেই। তৈরি করে দেওয়ার জন্য কাকেই বা বলব?” গণতন্ত্রের বৃহত্তম উৎসবে রাজনীতিকরা যখন ভোটারদের দলে টানতে চেষ্টা করছেন তখন সামাজিক মূলধনবিহীন এই বিধবারা মনে করছেন, তাঁদের কোনও রাজনৈতিক পুঁজিও নেই কারণ তাঁদের অধিকাংশই নিবন্ধিত ভোটার নন। বৃন্দাবন, রাধাকুঞ্জ ও গোবর্ধনের সরু সরু গলির কোণায় কোণায় তাঁদের বঞ্চনার কাহিনী শোনা যায়, প্রতিধ্বনিত হয়। এই সব এলাকায় সাদা শাড়ি পরিহিতা নারীরা হয় ভিক্ষা করছেন, নয়ত মন্দিরের বাইরে ‘ভাণ্ডার’ বা বিনামূল্যে খাবারের জন্য অপেক্ষারতা। অনেকে আবার মাত্র ২০ টাকার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা ভজন গেয়ে চলেছেন।
অনেকেই এই রাজনৈতিক উদাসীনতাকে তাঁদের অদৃষ্ট বলে মেনে নিয়েছেন। এই সত্য তাঁরা বুঝে গিয়েছেন যে, তাঁরা ভোটার নন, ফলত তাঁদের কোনও গুরুত্ব নেই। মথুরা লোকসভা আসনের ১৮ লক্ষ ভোটারের মধ্যে ১ শতাংশেরও বেশি ভোট এই নারীদের দখলে। যদিও কোনও সরকারি পরিসংখ্যান নেই। এই এলাকায় যে সব এনজিওগুলি কাজ করছে তাদের অনুমান এখানে ১০ থেকে ১২ হাজার বিধবা বাস করেন এবং এঁদের অধিকাংশই এসেছেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে। সামান্য যোগাযোগ ও টাকাকড়ি নিয়ে তাঁদের পক্ষে ভোটার কার্ড জোগাড় করা কঠিন।
এক স্বেচ্ছাসেবী বলেন, “এখন শুধু পশ্চিমবঙ্গ থেকে নয়, মহারাষ্ট্র, গুজরাত, ছত্তিশগড় ও মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্য থেকেও নারীরা আসছেন। আমি প্রতিদিন ২৫-৩০টা ফোন কল পাই। আমরা ৪০০ নারীর দেখভাল করি কিন্তু এমন নারীর সংখ্যাই বেশি যাঁরা রাস্তায় থাকতে বাধ্য হন। এঁদের মধ্যে মেরেকেটে ৫-৭ শতাংশের ভোটার কার্ড রয়েছে। আমরা এঁদের আধার কার্ড করে দিয়েছি। অনেকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও খুলে দেওয়া হয়েছে, তবে ভোটার কার্ডের জন্য সরকারি দফতরে গিয়ে গিয়ে আমরা ক্লান্ত।”
অধিকাংশ বিধবাই শহর থেকে দূরে যেতে চান না কারণ কৃষ্ণ মন্দিরে আসতে তাঁদের অসুবিধা হবে এবং তাঁদের দৈনন্দিন “দর্শন” ও “ভজনে” ব্যাঘাত ঘটবে। এই অঞ্চলের বিজেপি সাংসদ হেমা মালিনী সহমত যে, বিধবারা নিজেদের জায়গা ছেড়ে অন্যত্র যেতে অনিচ্ছুক। হেমা বলেন, “আমরা তাঁদের জন্য চিন্তিত, তাই ২০১৮ সালে আমরা কৃষ্ণ কুটির নির্মাণ করে দিয়েছি। এখানে আধুনিক সমস্ত ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু সেখানে থাকার জন্য তাঁদের বোঝানো শক্ত। আমরা কী করতে পারি?”
অনেক বিধবা বেসরকারি বা সরকারি আশ্রমে আশ্রয় নিয়েছেন, কিন্তু এঁদের অধিকাংশই জোলো, ঝুল-পড়া, নোংরা ভাড়ার বাড়িতে বাস করেন। চার ঘন্টা ভজন গাওয়ার পর তাঁরা একটি করে টোকেন পান। এই টোকেন দিয়ে তাঁরা ১০ টাকা, চা ও একবেলা খাবার পান। তবে, ভজন গাওয়ার সুযোগ পাওয়ার জন্যও দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয়। সব দলের রাজনীতিকরা ভোটারদের মন জয়ের চেষ্টায় যখন গলদঘর্ম করছেন তখন এই বিধবারা পাদপ্রদীপের বাইরে, বর্জ্য বস্তুর মতো। অনেকে বলছেন, তাঁরা তাঁদের অদৃষ্টকে মেনে নিয়েছেন–বৃজভূমির আনাচে কানাচে অজ্ঞাত পরিচয় লাশ হয়ে পড়ে থাকবেন একদিন।