মোকতার হোসেন মণ্ডল ও পুবের কলম ডেস্ক: মালদা জেলার রতুয়া ২ ব্লকের চৌ-দুয়ার গ্রাম। এখান থেকে একজন-দু’জন নয়, ১৪ জন মজদুর-মিস্ত্রি মিজোরামে রেলের ব্রিজ তৈরি করতে গিয়ে মর্মান্তিকভাবে নিহত হয়েছেন। তাঁদের লাশ ইতিমধ্যে এসে গেছে এবং গ্রামবাসী ও স্বজনদের বুক ফাটা কান্না এবং আহাজারির মধ্যে তাঁদের দাফনও সম্পন্ন হয়েছে। রাজ্যপাল আনন্দ বোস এসে রেলের তরফ থেকে কয়েকজন নিহতের পরিবারের হাতে চেক তুলে দিয়েছেন। মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমও মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিনিধি হিসেবে আর্থিক সহায়তা নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন।
মারাত্মক জখম হয়েও একজন শ্রমিক-মিস্ত্রি কিন্তু বেঁচে রয়েছেন। তাঁর বাড়ি ওই চৌ-দুয়ার গ্রামে। বিস্ময়ের কথা, তাঁর খোঁজখবর রেল বা সরকারের অন্য পর্যায়ে মোটেই নেওয়া হচ্ছে না। তাঁর নাম নাজিম হোসেন। এত বড় একটি দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর তাঁকে রেলওয়ে কর্তা-ব্যক্তিরা বা পুলিশ-প্রশাসন নয়, একটি নার্সিংহোমে নিয়ে যায় স্থানীয় বাসিন্দারা। তারপর নাজিম হোসেন সেই নার্সিংহোমেই পড়েছিলেন। মালদার এই গুরুতর আহত তরুণটিকে উন্নত চিকিৎসা কিংবা বাংলায় পাঠানোর কোনও ব্যবস্থাই করা হয়নি। এমনকী মালদার জেলাশাসক বা প্রশাসনের অন্য ব্যক্তিরাও তাঁর কোনও খোঁজখবর নেননি বলে চৌ-দুয়ারের লোকেরা পুবের কলম-এর সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
কীভাবে ওই দুর্ঘটনা হল, তার এক জীবন্ত বর্ণনা দিয়েছেন নাজিম হোসেন যা ভিডিয়োতে ধারণ করা রয়েছে। নাজিম বলেন, সে দুর্ঘটনার কয়েক মিনিট আগেই বুঝতে পেরেছিল, বিরাট এক অ্যাক্সিডেন্ট হতে চলেছে। কারণ, প্রবলভাবে সেখানে রাখা মেশিনারি থেকে পর পর আওয়াজ হচ্ছিল। নাজিম বলেন, সে ইঞ্জিনিয়ারবাবুদেরকে সতর্ক করেছিল। কিন্তু কিছু করার আগেই নির্মীয়মাণ সেই রেল সেতুতে ঘটনা ঘটে যায়। নাজিম হোসেন বলেন, সেখানে যারা কাজ করছিল তারা আমার চোখের সামনেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। আমারও মনে হচ্ছিল, আমার বাঁচার আর কোনও সম্ভাবনা নেই। তবুও আমি আল্লাহর নাম স্মরণ করে ঝাঁপ দিই। আমার উদ্দেশ্য ছিল, ঝাঁপ দিলে হয়তো আমার লাশ লোকেরা সহজে খুঁজে পাবে। কিন্তু বিমে আটকে গিয়ে আহত হলেও আমার প্রাণ যায়নি।
নাজিম আরও বলেন, এরপর ওই দুর্গম এলাকার একটি নার্সিংহোমে আর কেউ আমার খোঁজখবর নেয়নি। না রেলের অফিসাররা, না মিজোরাম সরকার, না মালদার প্রশাসন। আমি যন্ত্রণা ও সঠিক চিকিৎসার অভাবে ধুঁকতে থাকি। কী করে ঘরে ফিরব, মালদায় পরিবারের লোকদের দেখতে পাব, এটাই ছিল আমার চিন্তা। ফোনে কোনওক্রমে পরিবারের লোকেদের আমার অবস্থা জানাই। আমাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য তাঁরা ছুটে আসে এবং তাঁদের সঙ্গেই আহত অবস্থায় আমি কোনওক্রমে মালদায় ফিরে আসি। কেউ আমায় আর্থিক বা চিকিৎসায় সহায়তা করেনি। এসে আমার গ্রামের বাড়িতেই জখম-যন্ত্রণা নিয়ে পড়ে আছি।
গ্রামের মহিলারা জানালেন, চৌ-দুয়ার গ্রামের বেশিরভাগ লোকই রুজি-রোজগারের খোঁজে রাজ্যের বাইরে চলে যায়। কারণ, গ্রামে থেকে সক্ষম কিশোর বা তরুণদের কাছে বিকল্প কোনও আয়ের ব্যবস্থা নেই। ছোট ব্যবসা করারও পুঁজি তাদের কাছে নেই। ফলে বেঁচে থাকা জন্য ছেলেদেরকে তাদের দূরদূরান্তে পাঠাতেই হয়। তারা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেই থাকেন, আমার সন্তানরা যেন সহি-সালামতে ফিরে আসে। যদি সরকার থেকে আমাদের ছেলেদের বিকল্প রোজগার বা কাজের কোনও ধরনের ব্যবস্থা করা হয়, কেন তারা বিদেশ-বিভুঁইতে যাবে?
পুবের কলম ও হিন্দুস্তান গেজেটের সাংবাদিক মোকতার মণ্ডল আহত নাজিম হোসেনের যে সাক্ষাৎকরা নিয়েছিল, তা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার পর মালদার জেলাশাসক নাজিমের বাড়িতে ফোন করে তাঁকে মালদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেন। সেই অনুযায়ী নাজিম হোসেন সোমবার সন্ধ্যায় মালদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আশা করা যায়, তাঁর উন্নতর চিকিৎসা হবে।
নাজিম হোসেনের পরিজনরা বিশেষ করে মহিলারা বলছেন, রেল তাঁকে কেন ক্ষতিপূরণ দেবে না বা চাকরি দেবে না, মালদার জেলাশাসকও কি নাজিম হোসেনকে আর্থিক সহায়তার কোনও বন্দোবস্ত করতে পারেন না?