পুবের কলম প্রতিবেদক: বর্তমান দুনিয়ায় একদিকে ইসলামোফোবিয়া, অন্যদিকে মুসলিমদের মধ্যে নানা ধরণের মাযহাবী দ্বন্দ্ব চলছে। ফলে অন্যান্য সম্প্রদায় এগিয়ে গেলেও আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার দিক থেকে পিছিয়ে পড়ছে বিশ্বের মুসলিমরা। এভাবে চলতে থাকলে মুসলিম উম্মাহ ক্ষতিই হবে। তাই সব কিছুর আগে প্রয়োজন একতা। সোমবার মৌলালী যুবকেন্দ্রে এক বিশেষ আলোচনাসভায় এমন কথাই বললেন উলামা ও বিশিষ্টরা।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি ইরানে গিয়েছিলেন সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরি-সহ বেশ কয়েকজন আলেম। তাঁরা সেখানকার বিশিষ্টদের সঙ্গে ধর্ম, শিক্ষা ও সামাজিক নানান ইস্যু নিয়ে আলোচনা করেন। সেখান থেকে একদল প্রতিনিধি এসেছেন কলকাতায়। তাঁদের নিয়েই ছিল এ দিনের আলোচনসভা। রাজ্যের নানান প্রান্ত থেকে বহু আলেম ও বিশিষ্টজন এ দিনের সভায় বক্তা ও শ্রোতা হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। মৌলালী যুবকেন্দ্রের স্বামী বিবেকানন্দ অডিটোরিয়াম ছিল শ্রোতা-দর্শকে পরিপূর্ণ।
এ দিনের সভায় মিল্লি ঐক্য নিয়ে আলোচনায় ইরান থেকে যেসব ইসলামি স্কলার অংশগ্রহণ করেন তাঁরা হলেন- ইসহাক মাদানি, ড. হামিদ শাহরিয়ারি, ড. ফালাহ-জাদে হাদী, সাবুতুল হুসাইনি প্রমুখ। অন্যদিকে বাংলার যেসব বুদ্ধিজীবী ও উলামা এদিন কওমী ঐক্য নিয়ে নিজেদের মতামত পেশ করেন তাঁরা হলেন, মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরি, মনজুর আলম, রেড রোডে ইমামে ঈদাইন ক্বারী ফজলুর রহমান, মুফতি আবদুস সালাম, পুবের কলম-এর সম্পাদক ও সাবেক সাংসদ আহমদ হাসান ইমরান, জমিয়তে আহলে হাদিসের জাকি মাদানি, আলমগীর সরদার, জামাআতে ইসলামি হিন্দের মাওলানা তাহেরুল হক প্রমুখ। মহিলা প্রতিনিধি হিসাবে ছিলেন মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ডের সদস্য উজমা আলম, সুব্বা আজিজ প্রমুখ।
মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরি বলেন, কুরআন ও হাদিসের আলোকে জীবন তৈরি করা ও কওমের মধ্যে বিভেদ দূর করার জন্যেই আমরা কাজ করতে চাই। এই উদ্দেশ্য নিয়ে ইরান গিয়েছিলাম। সেখানে দেখেছি, শিয়া-সুন্নির মধ্যে ফিকাহ সংক্রান্ত কিছু পার্থক্য থাকলেও মানুষ ঐক্যবদ্ধ। কলেমা ও ঈমানের প্রশ্নের সবাই এক। এই ভাবধারা তামাম-দুনিয়ার ছড়িয়ে দিতে পারলেই কওমের কল্যাণ হবে।
অন্যদিকে এদিনের সভায় ইরানের ভাষা ও ভারতের সম্পর্ক নিয়ে আলোকপাত করেন আহমদ হাসান ইমরান। তিনি বলেন, ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত কোর্ট এবং সরকারি ভাষা হিসাবে ভারতে ও বাংলায় ফার্সি ব্যবহৃত হত। হিন্দু-মুসলিম সবাই এই ভাষা চর্চা করতেন। শিয়া-সুন্নি নিয়ে সমাজে কতোই না দ্বন্দ্ব রয়েছে।
ইমরান বলেন, বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁ, ভারতের স্বাধীনতার প্রথম শহিদ সিরাজ উদ্দৌলা সবাই শিয়া ছিলেন। হাজি মুহাম্মদ মহসিনকে সবাই শ্রদ্ধা করেন, তাঁর পরিবার ইরানের থেকে আগত। শিয়া-সুন্নি নিয়ে নিজেরা বিভেদ করতে থাকলে কওমের বৃহত্তর স্বার্থ বিঘ্নিত হবে, তাই সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান, আহমদ হাসান ইমরান।
এ বিষয়ে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেইনি রহ-এর ভূমিকার কথাও তুলে ধরেন তিনি।
ইসরাইলের মতো দেশ পরমাণু গবেষণা ও বোমা তৈরির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও বাধা নেই, ইরান মানবিক কল্যাণে পরমাণু গবেষণা করায় পশ্চিমা বিশ্ব অবরোধ তৈরি করছে। ইরান মাথানত করেনি। তারা একাই আমেরিকা, ইসরাইল ও পাশ্চাত্য শক্তির সঙ্গে লড়াছে বলে মন্তব্য করেন ইমরান।
ক্বারী ফজলুর রহমান ইরানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক তুলে ধরেন। তাঁর কথায়, ইরানে ইমাম গাজ্জালির মাযার অযত্নে পড়ে রয়েছে, তা নিয়ে আগত প্রতিনিধিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ফজলুর রহমান। পাশাপাশি মাযহাবী বিভেদ ভুলে ঐক্যের বার্তা দেন তিনি।
জাময়াতের প্রতিনিধি মাওলানা তাহেরুল হক বলেন, মাযহাব নিয়ে দ্বন্দ্ব ভুলে গিয়ে আপোসে শান্তি ও ঐক্যের স্বার্থে সবাইকে এক হতে হবে।’
জমিয়তে আহলে হাদিসের দুই প্রতিনিধি মাওলানা জাকি মাদানিও এই সমাবেশের ঐক্যের বার্তা দেন। মোহতারমা সুব্বা আজিজ সাহেবাও বিশ্ব-জাহানের কল্যাণের জন্য দোয়া করেন এবং সবাইকে এক হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান।
ভারতের যে প্রতিনিধি দল ইরানে গিয়েছিল সেই দলের সঙ্গে ইরানের ধর্মীয় গুরুদের মধ্যে যে আলোচনা হয় সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন মাওলানা মনজুর আলম সাহেব। তিনি জানান, মাযহাবী দ্বন্দ্ব দূরে সরিয়ে কিভাবে ইসলামের শান্তি ও সম্প্রীতির বাণীকে সর্বত্র প্রসারিত করা যায় তা নিয়ে আলোচনা হয়।
ড. হামিদ শাহরিয়ার কলকাতা সমাবেশে এসে খুব ভালো লাগছে বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, একই ছাদের তলায় আহলে হাদিস, শিয়া-সুন্নি ও নানা মাযহাবের লোকজন সমবেত হয়েছেন, এটা ইতিবাচক দিক। এজন্য তিনি মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীকে ধন্যবাদ জানান।
তিনি বলেন, আমরা রাসূল সা-এর সৈনিক। তিনি সবাইকে একসঙ্গে থাকতে বলতেন, তাই আমাদের সবাইকে এক হতে হবে। মাযহাবের নাম করে নিজেদের মধ্যে বিভেদ করলে প্রকৃতপক্ষে যারা ইসলামের শত্রু তাঁদেরই সুবিধা হবে, তাই এইসব বিভেদ-দ্বন্দ্ব থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে রাখতে হবে। তিনি আরও বলেন, আল্লাহর রাসূল সব সময় আমাদেরকে ঈমান মজবুত করার কথা বলেছেন, আর ঈমান মজবুত করার একটি অন্যতম মাধ্যম হল অন্যের কথা শোনা এবং তাকে গুরুত্ব দেওয়া। তিনি বলেন, শিয়া কিংবা সুন্নি আর যাই বলুন না কেন, সবাই কুরআন, কাবা শরীফ, কলেমা ও নামাযের পাবন্দি করেন। তাই তাদের আলাদা ভাবার প্রয়োজন নেই।
এ প্রসঙ্গে তিনি ইরানের ধর্মীয় গুরু আয়াতুল্লাহ খোমেইনি রহ-এর কাজের দিকেও আলোকপাত করেন। তিনি আরও বলেন, আমরা যদি নিজেদের মধ্যেই হানাহানি করতে থাকি, তাহলে আমাদের পরাজয় হবে। আর সব কিছু ভুলে গিয়ে সকলে মিলে একসঙ্গে কাজ করলে ইসলাম-ফোবিয়া রুখে দিতে সক্ষম হব।
তেহরানের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের হানাফি ফিকারহ মুখ্য পরিচালক, সুন্নী আলেম মাওলানা ইসহাক মাদানী বলেন, মানুষের মধ্যে মতভেদ থাকাটা স্বাভাবিক। নবীর পরবর্তী সময়ে সাহাবীদের মধ্যেও নানা বিষয়ে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। কিন্তু ঈমানী প্রশ্নে কেউই আলাদা ছিলেন না।
এ নিয়ে তিনি হযরত আবু বকর রা. হযরত উমর রা. ও হযরত আলি রা.-এn প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, যখন কোন সংকট বা সমস্যা দেখা দিত তখন হযরত আবু বকর রা, হযরত উমর রা.-কে হযরত আলি রা. পরামর্শ দিতেন। খিলাফত নিয়ে তাঁদের মধ্যে একটা মতনৈক্য ছিল ঠিকই কিন্তু ইসলামের স্বার্থে সবাই যেকোনো সময় একে অপরের পাশে দাঁড়াতেন। নিজেদের মধ্যে এভাবে বিভেদ-বিদ্বেষ ছড়ালে যারা ইসলামের শত্রু তাদের চক্রান্তকে মজবুত করা হয়। ইসলাম সবসময় মানুষকে মহব্বতের কথা শেখায়, তাই নিজেদের মধ্যে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে বিভেদ না করে ঐক্যবদ্ধভাবে চলতে হবে বলে আহ্বান জানান ইসহাক মাদানি।
ইসলাম মুসলিম ও অমুসলিম সকলের প্রতি নেকি করতে বলেছেন। অমুসলিমদেরও আমাদের নেকির কথা বলতে হবে। পবিত্র কুরআন ও মূর্তি পূজকদের কোনওরকম নিন্দামন্দ বা গালি দিতে বারণ করেছেন। কারণ, সেক্ষেত্রে তারাও আল্লাহর নিন্দা করবে। সকল মানুষের ঐক্যের উপরও তিনি জোর দেন।