জঙ্গি সন্দেহে ডোমকল থেকে ছ’জন ও কেরল থেকে আরও তিনজন সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করেছিল জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ। তারপর কেটে গিয়েছে প্রায় সাড়ে তেরো মাস। গ্রেফতার হওয়া পরিবারের পরিজনদের সঙ্গে কথা বলে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ‘পুবের কলম’ প্রতিনিধি জিশান আলি মিঞা। আজ তৃতীয় কিস্তি।
হবু শিক্ষকের গায়ে জঙ্গি তকমা
মুর্শিদাবাদের সীমান্ত লাগোয়া জলঙ্গি সাগরপাড়া রাজ্যসড়কের ধারে ঘোষপাড়া গ্রামের বৃদ্ধ দম্পতি তজিমুদ্দিন মণ্ডল ও নাজেরা বিবির বাস। তাঁদের সাত ছেলের মধ্যে দু’জন বন্দি দিল্লির তিহার জেলে। প্রায় সাড়ে তেরো মাস আগে কেরলের এরনাকুলাম থেকে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা গ্রেফতার করে তাঁদের মেজো ছেলে মোশারফ হোসেনকে। তাদের ছ’নম্বর ছেলে আতিউর রহমানকেও গ্রেফতার করে ঘোষপাড়ার বাড়ি থেকে। বৃদ্ধ তজিমুদ্দিন ও নাজেরার দাবি তাঁদের দুই ছেলে নির্দোষ। ছেলেরা এনআইএ-র হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে অহেতুক প্রতিবেশীদের বাঁকা নজরেও পড়েছেন তাঁরা।
তজিমুদ্দিন বলেন– অভাবের সংসারে হাল ফেরাতে প্রায় ১২ বছর ধরে কেরলেই থাকত মোশারফ। সেখানে একটি কাপড়ের দোকানে কাজ করত সে। কেরলেই বিয়ে করে ভাড়া বাড়িতে সে ঘর বেঁধেছিল। বর্তমানে দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে কেরলেই কোনও রকমে দিন কাটাচ্ছেন মোশারফের স্ত্রী সুমিয়া। সেখানে সে একটি কোম্পানিতে কাজ নিয়েছেন বলে খবর।
সংসার চালানোর পাশাপাশি মোশারফ বৃদ্ধ আব্বা-আম্মার জন্য বাড়িতে টাকা পাঠাতেন। এনআইএ-র হাতে গ্রেফতার হওয়া ভাই আতিকুর পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী হওয়ায় তার পড়াশোনার খরচও পাঠাতেন মোশারফ।
জানা গিয়েছে, ইংরেজি অনার্স পড়তে পড়তে ডিএলএড কোর্স শেষ করেন আতিউর। স্বপ্ন দেখছিলেন শিক্ষক হওয়ার। বৃদ্ধ আব্বা-আম্মাও ভেবেছিলেন ছেলে চাকরি পেলে টিনের ছাউনি আর পাটকাঠির বাড়িতে আর থাকতে হবে না। সুদিন ফিরবে– মাথার উপর পাকা ছাদ হবে। কত স্বপ্ন। কিন্তু প্রায় সাড়ে তেরো মাস ধরে স্বপ্ন দেখা সেই চোখ কেবল দুই ছেলের জন্য চোখের জল ফেলছে। বৃদ্ধ আব্বা-আম্মা কেবল দু’হাত পেতে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছেন। আর কিই বা করতে পারেন তাঁরা।
আতিউরের পরিবারের লোকেদের অভিযোগ– স্বীকারোক্তির জন্য আতিউরকে প্রচণ্ড মারধর করেছিল তদন্তকারীরা। তাঁর চোখে– মাথায় আঘাত লাগলেও ঠিকমতো চিকিৎসা হয়নি। বর্তমানে চোখে সমস্যা থাকলেও জেলে চিকিৎসা হয় না বলে পরিবারের লোকেদের অভিযোগ। ১-২ মাস অন্তর জেল থেকে পরিবারের লোকেদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পায় আতিউর– মোশারফ। তখনই দুই ছেলের দুর্দশার কথা শুনতে শুনতে দু’চোখে বন্যা নামে তজিমুদ্দিন– নাজেরার।
মাটির দাওয়ায় বসে চোখের পানি মুছতে মুছতেই এ দিন নাজেরা বলেন– আমার দুই ছেলেকে অন্যায় করে ফাঁসানো হয়েছে। এর সঠিক তদন্ত করে আমার দুই ছেলে মুক্তির ব্যবস্থা করুক প্রশাসন। কিন্তু অসহায় মায়ের আকুতির কথা তদন্তকারীদের কাছে পৌঁছনোর কোনও মাধ্যম নেই পরিবারের লোকেদের কাছে। টাকার অভাবে উকিল পর্যন্ত দিতে পারেননি তারা। মানবাধিকার সংগঠন এপিসিআর যা তদবির করছে সেটাই শেষ বলে জানান পরিবারের লোকজন। তজিমুদ্দিন বলেন– সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি– দুই ছেলেকে ছাড়ানোর জন্য তদবির করার মতো উকিল পাব কোথায়?
আতিউর– মোশারফের ভাই ইউসুফ আহমেদ বলেন– আমার ভাই যদি দোষী হয়– তবে তাদের শাস্তি দিক– নইলে তাদের ছেড়ে দিক। অযথা এতদিন ধরে বিনা বিচারে জেলে বন্দি রাখার কোনও মানে হয় না।
দু’তিন মাস অন্তর পরিবারের লোকেদের সঙ্গে জেল কর্তৃপক্ষ বন্দিদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দেয়। কিন্তু দেখার জন্য আবেদন করার পর ১০-১২ দিন অপেক্ষা করতে হয়। ফলে খরচের কথা ভেবে তাদের দেখা করার সুযোগটুকুও পায়নি পরিবারের লোকেরা। আক্ষেপ করে ইউসুফ আহমেদ বলেন– বিচার শুরু হল না অথচ আমার দুই ভাইকে জঙ্গি তকমা দেওয়া হল। এর একটা সমাধান হওয়া উচিত। বন্দিদের চিকিৎসা– খাবার ও পোশাক নিয়ে সরব হন তিনি। তিনি বলেন– আমরা তো গরিব– আমাদের কথা জলঙ্গির ঘোষপাড়া থেকে দিল্লি পৌঁছবে না।