মক্কার পবিত্র মসজিদ আল হারামে ১৮ নভেম্বর জুমার নামাযে ইমামতি করেন শায়খ ড. আবদুল্লাহ্ বিন আওয়াদ আল্ জুহানি। নামাযের আগে খুতবায় তিনি মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আল্লাহর নির্দেশনা অনুসারে কাজ করার আহ্বান জানান। এখানে তাঁর বক্তব্যের সংক্ষিপ্ত অনুবাদ তুলে ধরা হচ্ছে।
অনুসারীদের সুসংবাদ দান ও সতর্কীকরণের জন্য আল্লাহ্তায়ালা রাসূল সা.-কে প্রেরণ করেছেন। রাসূল সা.-এর কাজই মাত্র এই দুইটি ছিল। আল্লাহ্তায়ালা বলেন , ‘আমি রাসূলদের শুধু সুসংবাদ দান ও সতর্কীকরণের জন্যই প্রেরণ করি। যে ঈমান আনে, শুধরে যায়; তার কোনও ভয় নেই, সে চিন্তিত হবে না।’ (সূরা আনআম, আয়াত : ৪৭)
আল্লাহ্তায়ালা পবিত্র কুরআনুল কারিমের অসংখ্য আয়াতে বিশ্বাসী, অনুগত, সৎকর্মপরায়ণ ও ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দানের আদেশ করেছেন। রাসূল সা.-এর সুসংবাদ দানের কিছু বিশেষ রীতি ছিল, তিনি (সা.) এর জন্য উপযুক্ত সময় নির্বাচন করতেন। শিক্ষাদান ও উপদেশ দানের ক্ষেত্রে উপযুক্ত মাত্রা বিবেচনা করতেন, যাতে সাহাবিরা বিরক্ত না হয়ে যান। হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. ও হযরত আবু মুসা আশআরি রা.-কে ইয়েমেনে পাঠানোর সময় রাসূল সা.তাঁদের বললেন, ‘সহজ কোরো, কঠিন কোরো না। সুসংবাদ দিও, ঘৃণা সৃষ্টি কোরো না। একে অপরকে মেনে চলো, মতভেদ কোরো না।’ (বুখারী)
ইবনে হাজার আসকালানি রহ. এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘হাদিসের উদ্দেশ্য হচ্ছে, নও-মুসলিমদের ভালবাসা দেখাতে হবে। শুরুতে তাদের ওপর কঠোরতা করা যাবে না। গুনাহ থেকে নিষেধ করতে হবে দরদ ও মহব্বতের সঙ্গে; যাতে তারা নিষেধকে গ্রহণ করে নেয়। দ্বীনি ইলম শেখানোর ক্ষেত্রে মাত্রা বিবেচনা করতে হবে। কারণ, যে বিষয়টি শুরুর দিকে সহজ হয়, গ্রহণকারীর কাছে সেটি ভাল লাগতে শুরু করে। খোলা মনে সে তা গ্রহণ করে। পরবর্তী সময়ে বিধি-বিধানের মাত্রা বেশি হলেও সমস্যা হয় না। সে বেশি গ্রহণ করতেও আগ্রহী থাকে।’
সুসংবাদ দান নবীর কর্মপন্থা
রাসূল সা. সবসময় সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ প্রদান করতেন। এটি তাঁর (সা.) অনন্য কর্মপন্থার অংশ। কেউ প্রশংসাযোগ্য কোনও কাজ করলে তিনি (সা.) তাঁর প্রশংসা করতেন। তাঁকে জান্নাতে উঁচু মর্যাদা প্রাপ্তির সুসংবাদ দিতেন। এটি তাঁকে ও তাঁর পাশাপাশি অন্যদের আল্লাহ্র আনুগত্যে অটল থাকার প্রতি উদ্বুদ্ধ করত। এই কারণে মুসলমানের কর্তব্য হল, সবসময় অপর মুসলমানকে সুসংবাদ দেবে, তার সাফল্যে অভিনন্দন জানাবে।
একবারের ঘটনা। রাসূল সা.-কে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী হযরত আবু হুরায়রা রা. খুঁজে খুঁজে হয়রান। হঠাৎ জানা গেল, তিনি (সা.) এক খেজুর বাগানে অবস্থান করছেন। বাগানটি দেওয়ালে ঘেরা। সদর দরজা আটকানো। হযরত আবু হুরায়রা রা. একটি সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে তাতে প্রবেশ করলেন। রাসূল সা. তাঁকে দেখে বললেন, ‘আমার এই জুতো জোড়া নিয়ে যাও। এই দেওয়ালের বাইরে যাকেই এমন পাবে, যে দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে এই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, আল্লাহ্ ছাড়া আর কোনও মাবুদ নেই; তাকেই জান্নাতের সুসংবাদ দেবে।’ (মুসলিম)
মুমিন সুসংবাদ ছড়াবে। মানুষকে উজ্জীবিত করবে। ভাল কাজে উৎসাহিত করবে। সাহস জোগাবে। শক্তি জোগাবে। আশা জাগাবে। বেশি বেশি নেক আমল করতে উদ্বুদ্ধ করবে। রাসুল সা. বলেন,’সহজ করো। কঠিন কোরো না। সুসংবাদ দাও, ঘৃণা ছড়িও না।আল্লাহ্র সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করো। সর্বোত সুন্দরভাবে রাসুল সা. এর আনুগত্য করো। মুসলিম
সুসংবাদ দান ইসলামি শিষ্টাচারের অংশ
সুসংবাদ দান ইসলামি শিষ্টাচারের অংশ। কল্যাণের সুসংবাদ দানের দীক্ষায় সব মুসলমানের দীক্ষিত হওয়া উচিত। এটি যেন সবার হৃদয়ে বদ্ধমূল হয়ে যায়। মুসলমান মুসলমানকে সুসংবাদ দেবে, ভাল কাজে শুভেচ্ছা জানাবে, আমলে উদ্বুদ্ধ করবে, আনুগত্যে অটল থাকতে উৎসাহ জোগাবে। রাসূল সা. বলেন, ‘যারা অন্ধকারে বেশি বেশি মসজিদে গমন করে, কেয়ামতের দিন তাদের পরিপূর্ণ আলোকপ্রাপ্তির সুসংবাদ দাও।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)
রাসূল সা. একবার সাহাবিদের নিয়ে এশার নামায আদায় করলেন। নামায শেষে সবাই ফিরে যাওয়ার আগে রাসূল সা. বললেন, ‘একটু দাঁড়াও। সুসংবাদ গ্রহণ করো। তোমাদের ওপর আল্লাহর এ এক অমূল্য নেয়ামত যে, এই সময়ে তোমরা ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ নামায আদায় করছে না।’ হযরত আবু মুসা আশআরি রা. বলেন, ‘আমরা রাসূল সা.-এর কাছ থেকে এ কথা শুনে খুশি মনে ঘরে ফিরে গেলাম।’ (বুখারী)
বিপদে সান্ত্বনা জানানো মুমিনের কর্তব্য
বিপদের সময় মুমিন সান্ত্বনা চায়। বিপদ থেকে মুক্তির সুসংবাদ শুনতে চায়। সে চায়, কেউ এসে বলুক, ‘এই তো তোমার বিপদ অচিরেই কেটে যাবে।’ অথবা এই বলে সান্ত্বনা দিক যে, ‘এই বিপদে ধৈর্য ধারণ করলে আল্লাহর কাছে অনেক বড় প্রতিদান লাভ করবে।’ উম্মুল আলা অসুস্থ ছিলেন। রাসূল সা. তাঁর খোঁজ নেওয়ার জন্য গেলেন। তখন রাসূল সা. তাঁকে বললেন, ‘উম্মুল আলা! সুসংবাদ গ্রহণ করো। মুসলমানের রোগ তার পাপগুলো এমনভাবে দূর করে, যেমন আগুন লোহার মরিচা দূর করে।’ (তিরমিজি)
মুমিন বিপদে মানুষকে সান্ত্বনা দেয়। মানুষের ব্যথা-বেদনা দূর করে। মন খুশি করার চেষ্টা করে। হাররার ফেতনার সময়ের ঘটনা। হযরত আনাস ইবনে মালেক রা.-এর সন্তান-সন্ততি নিহত হয়। হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম রা. তাঁকে এক সান্ত্বনামূলক পত্র প্রেরণ করেন। তাতে তিনি লেখেন, ‘আমি আপনাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ প্রদান করছি। আমি রাসূল সা.-কে বলতে শুনেছি, হে আল্লাহ্! আনসারদের ক্ষমা করুন। ক্ষমা করুন তাঁদের পুত্রদের এবং তাঁদের পুত্রের পুত্রদেরও।’ (মুসনাদে আহমদ)
মুমিনের জন্য উভয়কালেই সুসংবাদ
যারা ঈমান আনবে ও আল্লাহ্কে ভয় করবে, আল্লাহ্ তাদের বিশেষ সুসংবাদ দান করেছেন। তিনি (সা.) বলেন, ‘তাদের জন্য পার্থিব জীবনে সুসংবাদ রয়েছে এবং পরকালেও। আল্লাহর সিদ্ধান্তে কোনও পরিবর্তন হয় না। এটাই মহাসফলতা।’ (সূরা ইউনুস, আয়াত : ৬৪)
পার্থিব জীবনে তাদের সুসংবাদ হল, অন্য মুসলমানের কাছে তারা গ্রহণযোগ্য হবে। মুসলমানরা তাদের সৎকাজের শুকরিয়া আদায় করবে। রাসূল সা.-কে একবার জিজ্ঞেস করা হল, ‘কেউ যদি ভাল কাজ করে আর মানুষ তার প্রশংসা করে, এটি কেমন?’ রাসূল সা. বললেন, ‘এটা মুমিনের নগদ সুসংবাদ।’ (মুসলিম)
মুমিনের চরিত্র এমন হওয়া উচিত যে, সে অপর মুসলমানকে আশান্বিত করবে। শুভ পরিণামের সুসংবাদ দেবে। অন্য মুসলমানের যেন তার থেকে কোনও ধরনের কষ্টের শিকার না হতে হয়।
ঘৃণা ছড়ানো উচিত নয়
পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ্র এসব নির্দেশনা জানার পর কোনও মুমিনের ঘৃণাজীবী হওয়া, মানুষকে হতোদ্যম করা ও অপদস্থ করা উচিত নয়। এটা মুমিনের কাজ হতেই পারে না। মুমিন সুসংবাদ ছড়াবে। মানুষকে উজ্জীবিত করবে। ভাল কাজে উৎসাহিত করবে। সাহস জোগাবে। শক্তি জোগাবে। আশা জাগাবে। বেশি বেশি নেক আমল করতে উদ্বুদ্ধ করবে। রাসূল সা. বলেন, ‘সহজ করো। কঠিন কোরো না। সুসংবাদ দাও। ঘৃণা ছড়িও না। আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করো। সর্বোত সুন্দরভাবে রাসূল সা.-এর আনুগত্য করো।’ (মুসলিম)
আল্লাহ্তায়ালা বলেন, ‘যারা তাগুতের ইবাদাত বর্জন করে ও আল্লাহর দিকে ধাবিত হয়, তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ। আমার সেসব বান্দাহ্দের সুসংবাদ দাও, যারা আমার বাণী শ্রবণ করে ও তার উত্তম শিক্ষার অনুসরণ করে। তাদেরই আল্লাহ্তায়ালা হেদায়েত দান করেছেন। তারাই বুদ্ধিমান।’ (সূরা যুমার, আয়াত : ১৭-১৮)