পুবের কলম, ওয়েবডেস্ক: মজলুম ফিলিস্তিনিদের কান্নার আর এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। আশির দশকের শাবরা-শাতিলার মর্মান্তিক ও নৃশংস গণহত্যার ঘটনাকে উসকে দিয়ে এবার হামলা চলেছে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের জেনিন শরণার্থী বাসস্থানে। হাজার হাজার মানুষের পলায়ন, বোমারু বিমানের আঘাতে হওয়া ধ্বংসস্তূপ থেকে নিজের বাড়িটি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা কিংবা কোনও প্রিয়জনের লাশের সন্ধান-এইসব চিত্র যেন ফিলিস্তিনের গণহত্যার আরেক অধ্যায়ের কথা রচনা করে। নিষ্ঠুর হত্যালীলায় খুনে রাঙা হয়ে উঠেছে যুদ্ধবাজ নেতানিয়াহুর হাত। বিশ্ব নীরব। জার্মানিতে কথিত হলোকস্টে ইহুদি-নিধনের কথা বার বার শোনা যায়। তাদেরকে ‘আশ্রয়’ দিতেই ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের ভূমি থেকে বিতাড়িত করে ইসরাইলের জন্ম। সেই ইসরাইলি হানাদারদের হাতেই চলছে ফিলিস্তিনিদের গণহত্যা। ইসরাইলিরা কি ফিলিস্তিনিদের কষ্ট বুঝতে পারছে? ইসরাইলের সর্বশেষ হামলায় লন্ডভন্ড হয়ে গেছে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের জেনিন শহর। বিমান হামলায় জেনিনের ৮০ শতাংশ ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। নিহত অন্ততপক্ষে ১২ জন। শহর পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। বুধবার জেনিন থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু হওয়ার পর পশ্চিম তীরের গাজায় বিমান হামলা শুরু করেছে ইসরাইলি বাহিনী। অর্থাৎ ফিলিস্তিনের এক এলাকায় অভিযান স্তিমিত হয়ে আসার পর আরেক এলাকায় অভিযান শুরু করেছে যায়নবাদীরা।
২ জুলাই ভোর রাতে শুরু হয় ইসরাইলের এই অভিযান। গাজার বিষয়ে ইসরাইল যত কঠোর, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক বা পশ্চিম তীরের ক্ষেত্রে সাধারণত তেমনটা দেখা যায় না। তবে এবার জেনিনের এই অভিযান নতুন করে আতঙ্কিত করে তুলেছে পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের। ইসরাইল দাবি করেছে, তারা শুধু জঙ্গিদের কমান্ড সেন্টার ধ্বংস করেছে। তাদের নাকি টার্গেট ছিল শুধু অস্ত্র ও বিস্ফোরক কারখানাগুলো। প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কেন এই ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা। অন্তত দেড় শতাধিক সাঁজোয়া যানে করে প্রায় দশ হাজার ইসরাইলি সেনা এই অভিযানে অংশ নিয়েছিল। ইসরাইলি সেনাবাহিনী, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা অংশ নেয় এই অভিযানে। দুই দশক আগের হামলার পর জেনিন শহরে এ ধরনের বড় অভিযানের ঘটনা আর ঘটেনি। আধা বর্গকিলোমিটারের কম আয়তনের এ শিবিরে ১৮ হাজারের মতো শরণার্থী বাস করে। জেনিনের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন ওয়ালেদ মানসুর। কুকুরের কামড়ের দাগ ছিল তার শরীরে। তিনি বলেন, ইসরাইলের সেনারা আমাদের বাড়ি এসেছিল। দরজা ভেঙে তারা বাড়িতে প্রবেশ করে। সেনাদের সঙ্গে কুকুর ছেড়ে দেয় তারা। সেই কুকুর আমাকে আক্রমণ করেছিল। ২০০২ সালে তারা এই শরণার্থী শিবিরের অর্ধেক ধ্বংস করেছিল। আমরা এবার এটা আশা করিনি যে তারা এখানকার রাস্তাঘাটও ধ্বংস করে যাবে।
জেনিনের শরণার্থী শিবিরের আরেক বাসিন্দা আহমেদ আবু বলেন, ইসরাইলের সেনারা এই শিবির ধ্বংস করতে চান। তিনি বলেন, তারা বলেছিলেন সশস্ত্র ব্যক্তিদের ধরতে তারা সেখানে এসেছে। কিন্তু সেই ব্যক্তিদের না ধরে সাধারণ মানুষদের হতাহত করে ফিরে গেল। ইতিমধ্যে জেনিনে ফিরে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন ফাতিনা। জেনিনে ফিরে ফাতিনা ভয়াবহ দৃশ্য দেখতে পান। তিনি যেদিকেই তাকান, দেখেন শুধু ধ্বংসস্তূপ আর ধ্বংসস্তূপ। অভিযানের মুখে ফাতিনাসহ ১০ জন একসঙ্গে পালিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ফাতিনার পরিবারের লোকজন ও তার প্রতিবেশীরা ছিলেন। ফিরে আসার পর চারপাশ দেখে ফাতিনা বলেন, আমার বাড়ি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। সবকিছু ভাঙা, পোড়া। সবকিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফাতিনার মতো আরও যারা জেনিনে ফিরে এসেছেন, তাদের জন্য এখন খাবার, পানি ও আশ্রয়ের স্থান জরুরি হয়ে পড়েছে। ফাতিনা বলেন, আজ রাতে আমরা রাস্তায় ঘুমাব। ঘর যেখানে ছিল, সেখানে বসার মতো অবস্থাও নেই। আমাদের বা প্রতিবেশীদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।
ইসরাইলের এই অভিযানের নিন্দা জানিয়েছে ইরান, মিশর, জর্ডান, আরব লিগসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন ও দেশ। এ ছাড়া অভিযান শুরুর আগে থেকেই এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিল রাষ্ট্রসংঘ। ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি তুলে ধরে রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব গুতেরেস ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছেন। তিনি জানান, শুক্রবার এ নিয়ে বৈঠকে বসবেন তিনি।
ইসরাইলি বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে আনুমানিক তিন হাজার ফিলিস্তিনি জেনিন শরণার্থী শিবির থেকে পালিয়েছে। জেনিনের স্কুল ও অন্যান্য আশ্রয়কেন্দ্রে বাস্তুচ্যুতদের থাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এ শিবিরটিকে ঘিরে পশ্চিম তীরে সহিংসতাও বাড়ছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে জেনিনে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর অভিযান নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে জেনিনের শরণার্থী শিবিরকে ঘিরে ইসরাইলি সেনাদের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের বেশ কয়েকবার সংঘর্ষ হয়েছে। গত মাসে ইসরাইলি ড্রোন হামলায় এখানে ৬ ফিলিস্তিনি নিহত হন। রাষ্ট্রসংঘের হিসাবে, এ বছর ইসরাইলি হামলায় মোট ১৪৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। জেনিনের শরণার্থী শিবিরে খাদ্য এবং চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছাতে বাঁধা দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মুখপাত্র ক্রিশ্চিয়ান লিন্ডমায়ার। তিনি বলেছেন, ‘হামলার পরপরই যারা আহতদের সেবায় শরণার্থী শিবিরে প্রবেশ করতে চেয়েছিলেন তাদের বাধা দেওয়া হয়েছে।’ ইসরাইলি বাহিনীর বুলডোজার শরণার্থী শিবির অভিমুখের রাস্তাটি প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছে। ফলে সেখানে কোনোভাবেই অ্যাম্বুলেন্স যাচ্ছে না।
অসহায় ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরাইলি হানাদার বাহিনীর এই আক্রমণ পরিকল্পিত এক গণহত্যার ছক। যুদ্ধবিমান, ড্রোন, ট্যাঙ্ক নিয়ে ২০০০ সেনার আক্রমণ। গভীর রাতে মারাত্মক ভয় নিয়ে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুর পালানোর দৃশ্যটি ছিল হৃদয়বিদারক। আশির দশকে লেবাননের গৃহযুদ্ধের সময় এক ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞ স্তম্ভিত করেছিল গোটা বিশ্বকে। বেইরুটের এক ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরে ঢুকে খ্রিস্টান মিলিশিয়ারা হত্যা করেছিল প্রায় ৫ হাজার ফিলিস্তিনি নারী, পুরুষ ও শিশুকে। ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন অনেক ফিলিস্তিনি নারী। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ইসরাইলের তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এরিয়েল শ্যারনকে দায়ী করা হয়। সাবরা ও শাতিলার কসাই হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করে শ্যারন। গণহত্যার পর ৪০টি বছর পেরিয়েছে। ইনসাফ মেলেনি। জেনিনের ফিলিস্তিনিদের অশ্রু কে মোছাবে?