পুবের কলম প্রতিবেদকঃ মাওলানা মাহমুদ মাদানির নেতৃত্বাধীন জমিয়তে উলেমায়ে হিন্দের একটি দল ত্রিপুরার মুসলিম-বিরোধী দাঙ্গাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করে ১২টি মসজিদের তালিকা পেশ করেছে– যেগুলি হিন্দুত্ব বাহিনী ভেঙে দিয়েছে অথবা জ্বালিয়ে দিয়েছে। জমিয়তের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম বিজেপি শাসিত ত্রিপুরার সেই সব অঞ্চল পরিদর্শন করেছে– যেখানে হিন্দুত্ববাহিনী আক্রমণের নিশানা করেছে মুসলিমদের। মসজিদ জ্বালিয়ে দেওয়া এবং ভেঙে ফেলার প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন তাঁরা।
এর ফলে ত্রিপুরার ডাইরেক্টর জেনারেল অব পুলিশের সেই দাবি নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে যেখানে তিনি বলেছিলেন– ত্রিপুরায় কোনও মসজিদের উপর হামলা হয়নি। জমিয়তের জাতীয় প্রেসিডেন্ট মাওলানা মাহমুদ মাদানি বলেন– ত্রিপুরার ডিজিপি দাবি করেছিলেন মসজিদ ভাঙা কিংবা জ্বালিয়ে দেওয়ার অভিযোগ মিথ্যা।
যেখানে পুলিশের উচ্চপদস্থ আধিকারিকের মানসিকতা এই– তখন সেখানে সব কিছুই ঘটে যেতে পারে। দিল্লি পৌঁছে এক বিবৃতি জারি করেছেন মাদানি। সেই বিবৃতিতে তিনি বলেছেন– যারা মসজিদ জ্বালিয়ে দিল– যারা পয়গম্বর হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর অবমাননা করল– তাদের কোনও শাস্তি হল না। বিষয়টা খুবই হতাশা এবং দুঃখজনক। সরকারের এই ধরনের মানসিকতা এবং মনোভাব দেশের ঐক্য– সহনশীলতা এবং অখণ্ডতার নীতির পরিপন্থী। মুসলিম-বিরোধী দাঙ্গায় ত্রিপুরায় যেসব মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার একটি তালিকা পেশ করেন মাওলানা মাদানি। সেগুলি হল- ১) নারোরাতেলা জেলার সিপাহিজালার মসজিদ ২) আগরতলা কৃষ্ণনগর মসজিদ ৩) আগরতলা চন্দ্র মসজিদ ৪) রাতা চার মসজিদ ৫) হাজিগাঁও পালবাজার জামা মসজিদ ৬) সায়াদার পার্ক রাতাচারা মসজিদ ৭) চাম টিলার জামা মসজিদ ৮) পানিসাগরের সিপিআরএফ মসজিদ ৯) দরগাহ বাজারের জামিয়া মসজিদ ১০) গোমতী জেলার মহারানি বাজারের মসজিদ ১১) সোনাচূড়া উত্তর কলম চোয়া মসজিদ এবং ১২) সিপাহিজালার বালোচ মসজিদ।
জমিয়ত টিম জানায়– কীভাবে হিন্দুত্ববাদী দুষ্কৃতীরা এইসব মসজিদকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে সেটা সরজমিনে তদন্ত করলেই বোঝা যায়। অথচ স্থানীয় পুলিশ মসজিদগুলির উপর হামলার ঘটনা অস্বীকার করে চলেছে নির্লজ্জভাবে। মুসলিম সম্পত্তি এবং মসজিদগুলি যে ঘৃণার শিকার হয়েছে– তার খবর প্রকাশিত হয়েছে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে। ত্রিপুরা পুলিশ সম্প্রতি চালাকি করে পানিসাগর মসজিদের ছবি প্রকাশ করেছে– যেখানে টুপি পরে একজন বসে আছেন। এই ছবি দেখিয়ে ত্রিপুরা পুলিশ প্রমাণ করতে চাইছে যে– মসজিদের উপর কোনও হামলা হয়নি। অথচ যেসব মসজিদের উপর হামলা হয়েছে– সেটা বেমালুম চেপে যাচ্ছে পুলিশ।
পানিসাগরে মুসলিম-বিরোধী ভিড় যে অপর দু’টি মসজিদে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে– সেগুলির প্রসঙ্গে কিছুই বলছে না। ত্রিপুরায় মুসলিম জনসংখ্যা খুবই কম। যে মুসলিমরা সেখানে বাস করেন– তাঁরা আর্থিক এবং শিক্ষার দিক থেকে খুবই পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মধ্যে পড়েন। তাঁরা এখন ভীতি এবং আশঙ্কার পরিবেশে বাস করছেন। তাঁরা কারওর সামনে ভয়ে মুখ খুলছেন না। কারণ তারা মুখ খুললে তাদের হিন্দুত্ববাহিনী এবং পুলিশের রোষে পড়তে হবে। তাই মুখ বুজে তাদের উপর যাবতীয় অত্যাচার তারা সহ্য করে চলেছেন।
এঁদের মধ্যে কিছু সাহসী মানুষ আছেন– যাঁরা ত্রিপুরায় মসজিদগুলির উপর আক্রমণের বিবরণ দিয়েছেন। ২৩ অক্টোবরের রাতে সিপাহিজালা জেলার নারোয়ায় একটি মসজিদকে সম্পূর্ণভাবে ভেঙে ফেলা হয়। মাওলানা মুহাম্মদ কামাল হুসেন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন– কিছু অপরিচিত ব্যক্তি এই মসজিদে আগুন ধরিয়ে দেয়। মসজিদটি আগুনে প্রায় গোটাই পুড়ে যায়। পুলিশ এই মামলার এফআই দায়ের করলেও কাউকে গ্রেফতার করেনি। তিনি আরও বলেন– রাত ১০টা নাগাদ এই ঘটনা ঘটে যখন আমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
মাওলানা হুসেন জানান– এই জায়গায় কোনওদিন হিন্দু-মুসলিম সংঘাত হয়নি। মসজিদ জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনার পরেও এখানে শান্তি রয়েছে। পঞ্চায়েত সদস্য সুজুল ঘোষ মসজিদটির ধ্বংসাবশেষ দেখেছেন। তিনি এখানে স্থানীয় মুসলিমদের সঙ্গে কথাও বলেন। পানিসাগরের বাসিন্দারা বলছেন– মসজিদে কেরোসিন ছিটিয়ে আগুন ধরানো হয়। তবে এলাকার জামা মসজিদ বেঁচে গেছে। তবে এই এলাকায় দু’টি মসজিদের উপরে হামলা চালিয়েছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) দুষ্কৃতীরা পানিসাগরে যখন ভিএইচপি মিছিল বার করে– তখন এলাকার মুসলিমরা তাদের বাড়িঘর– দোকানপাট ছেড়ে জামা মসজিদের সামনে জড়ো হয়– যাতে এই মসজিদকে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে। তখন পুলিশ এসে ছবি তুলে নিয়ে যায়। তারা এরপর সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবিটি প্রচার করে বলে কোনও মসজিদের উপর হামলা হয়নি। কিন্তু যেসব মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেই সব মসজিদের ছবি পুলিশ দেখাচ্ছে না। ভিএইচপির মিছিল ফেরার সময় মুসলিমদের দোকানপাট লুট করে সেগুলি ভেঙে দেয়।
ত্রিপুরা সিপিএম-এর সাধারণ সম্পাদক জিতেন্দ্র চৌধুরি বলেছেন– যা হয়েছে সেগুলি লজ্জাজনক। ত্রিপুরার বিজেপি শাসনে মুসলিম-বিরোধী দাঙ্গা এই প্রথমবার হল।