পুবের কলম প্রতিবেদক: ফিলিস্তিনে চরম বর্বরতা চালাচ্ছে যায়নবাদী ইসরাইল। নৃশংসতার নজির স্থাপন করছে তারা। এই প্রেক্ষিতে বিশ্বের জনসমর্থন হারিয়েছে ইসরাইল। আল-আকসার জন্য লড়াইয়ে অকুতোভয় মুসলিমরা। ইসরাইলের পরাজয় শুরু হয়েছে, আল্লাহর মদদেই ফিলিস্তিন মুক্ত হবে। এমনই মন্তব্য করলেন রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ ও পশ্চিমবঙ্গ মাইনোরিটি কমিশনের চেয়ারম্যান আহমদ হাসান ইমরান।
রবিবার কলকাতার হুমায়ূন কবির ইনস্টিটিউটে মাইনোরিটি কাউন্সিল অফ বেঙ্গল আয়োজন করেছিল ‘ফিলিস্তিনে ইসরাইলি বর্বরতা: সমাধান কোন পথে’ শীর্ষক এক আলোচনা সভার। এদিনের সভায় বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও সমাজচিন্তকরা সকলেই ফিলিস্তিনে দখলদার ইসরাইলের বর্বরতার নিন্দা করেন। স্থির হয়, অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধের দাবি জানিয়ে আমেরিকান দূতাবাস, ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বাংলার রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীকে স্মারকলিপি জমা দেওয়া হবে।
এদিনের সভায় আহমদ হাসান ইমরান বলেন, ইসরাইলের পরাজয় শুরু হয়েছে। পৃথিবীর সাধারণ মানুষ ফিলিস্তিনের পক্ষে। তুরস্কে ১৫ লক্ষ লোক ইসরাইলের বিরুদ্ধে মিছিল করেছে। রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদের ভোটাভুটিতে ইসরাইল হেরেছে। ধীরে ধীরে বিশ্ব জনমত ইসরাইল ও আমেরিকার বিরুদ্ধে যাচ্ছে। ইংল্যান্ড, আমেরিকার মতো দেশেও ইসরাইল-বিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে প্রবলভাবে। তিনি আরও বলেন, আমরা বিশ্বাস করি গায়েবি সাহায্য ছাড়া কিছু সম্ভব নয়।
কাবা শরীফকে আক্রমণ করতে এসে আবরাহার যে অবস্থা হয়েছিল একদিন ইসরাইলের সেই অবস্থা হবে। আল-আকসা ছাড়বে না মুসলিমরা। আজ হোক, কাল হোক আল্লাহর মদদেই ফিলিস্তিন একদিন মুক্ত হবে ইনশাআল্লাহ।
তিনি আরও বলেন, আমরা সব সময় মজলুমের পক্ষে, ইনসাফের পক্ষে। আমেরিকা যখন ভিয়েতনামে হামলা করেছিল, তখন প্রতিবাদ করেছি। এখনও ফিলিস্তিনের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে কথা বলছি। হিরোশিমা থেকে নাগাসাকি— আমেরিকা বর্বরতা চালিয়েছে। কালো মানুষদের উপর নিপীড়ন করেছে। এরাই আবার গণতন্ত্রের কথা বলে, মানবাধিকারের কথা বলে! আহমদ হাসান ইমরান বলেন, মুসলিম শাসনে জেরুসালেমে সব ধর্মের মানুষের সম্মান ছিল। ইহুদি, খ্রিস্টান সবাই ভালোভাবে থাকতো। ইহুদিদের মুসলিমরা বিতাড়িত করেনি, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইহুদিদের তাড়িয়েছিল খ্রিস্টানরা। ইহুদিদের তারা ঘেটোতে বসবাস করতে বাধ্য করেছে।
ইসরাইলের লাগাতার আক্রমণের প্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠছে, চারপাশে মুসলিম দেশ থাকা সত্ত্বেও কেন তারা ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়াচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমানে সউদি আরব, মিশর, জর্ডানের শাসকরা আমেরিকার কথা মতো চলে। এইসব সামরিক, রাজতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক সরকারগুলো ক্ষমতা হারানোর ভয়ে ফিলিস্তিনের পাশে প্রকাশ্যে দাঁড়াতে পারছে না। কিন্তু ওইসব দেশের নাগরিক ফিলিস্তিনের পক্ষে এবং ইসরাইলি বর্বরতার বিরুদ্ধে।
এদিন মাইনোরিটি কাউন্সিল অফ বেঙ্গলের সভাপতি ও গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মেহেদি হাসান বলেন, ইহুদিদের নির্যাতন করেছে ইউরোপের খ্রিস্টানরা। অথচ ভূমি দেওয়ার কথা উঠলে আরবের জমি কাড়া হবে কেন? আমার বাড়িতে পাঁচটি রুম থাকলে তিনটি রুম অন্য কাউকে দিতে যাব কেন অযথা? অথচ সেটাই ঘটেছে। এখন ইসরাইল সব ঘরগুলিই দখল করে নিয়েছে। আর ফিলিস্তিনিরা বাথরুমে বন্দির জীবন কাটাচ্ছে। মৃত্যুবরণই যেন তাদের ললাটলিখন।
পশ্চিমবঙ্গ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান, অবসরপ্রাপ্ত আইএএস সেখ নুরুল হক বলেন, দুই তরফের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি যদি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে বড় ক্ষতি হবে। তেলের দাম বাড়বে, জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। দ্রুত যুদ্ধ বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। ফিলিস্তিন সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা দরকার। ভারত সরকার যুদ্ধ বন্ধে ভূমিকা নিক। পাশাপাশি এ ব্যাপারে তিনি রাষ্ট্রসংঘের তত্ত্বাবধানে দ্রুত ফায়সালা দাবি করেন। যুদ্ধবিরতির জন্য আমেরিকান দূতাবাসে স্মারকলিপি জমা দেওয়ার প্রস্তাবও পেশ করেন তিনি।
পশ্চিমবঙ্গ মুসলিম মজলিশ-এ-মুশাওয়ারাতের সেক্রেটারি মানজার জামিল যুদ্ধ বন্ধের আবেদন জানিয়ে বলেন, হামাসকে যারা সন্ত্রাসী বলছে, তাদের কাছে প্রশ্ন, ৭০ বছর ধরে ইসরাইল যেভাবে হত্যালীলা চালাচ্ছে সেটাকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বলবেন না? হাসপাতালে বোমা মারছে, চার হাজার শিশুকে খুন করেছে, তারপরেও চুপ থাকতে হবে? হামাস প্রতিক্রিয়া দেখালেই অপরাধী বলা হবে?
অন্যদিকে, প্রাক্তন পুলিশকর্তা মসিহুর রহমান বলেন, ইউক্রেন যখন ভূমিরক্ষার জন্য যুদ্ধ করছে তখন ইউরোপের অনেক দেশ ধন্যবাদ দিচ্ছে। কিন্তু ফিলিস্তিন যখন নিজের জমিনের জন্য লড়াই করছে তখন তাদের সন্ত্রাসী বলা হচ্ছে। নুরুল হকের মতো তিনিও আমেরিকান দূতাবাস ও ভারত সরকারকে স্মারকলিপি জমা দেওয়ার প্রস্তাব পেশ করেন। তিনি আক্ষেপের সঙ্গে জানান, বিশ্বের ২০০ কোটি মুসলিম এক বোতল পানি পৌঁছে দিতে পারছে না পিপাসার্ত ফিলিস্তিনিদের কাছে। এ ক্ষেত্রে কোনও ত্রাণসাহায্য সেখানে পাঠানো যায় কি না সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন প্রাক্তন পুলিশ অফিসার।
এদিনের গোলটেবিল আলোচনায় সমাজের বিদ্বজনদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। অধ্যাপক, উচ্চপদস্থ আধিকারিক, সমাজসেবীসহ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্টজনেরা সভায় মূল্যবান মতামত পেশ করেন। উপস্থিত ছিলেন মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সদস্য উজমা আলম, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মির রেজাউল করিম, অধ্যাপক সাজ্জাদ হোসেন, অধ্যাপক সাইদুর রহমান প্রমুখ।
উপনিবেশ-বিরোধী, কর্পোরেট-বিরোধী চর্চার পুরোধা ব্যক্তিত্ব ও হকার-কারিগর সংগঠনের অনতম সংগঠক বিশ্বেন্দু নন্দ এদিনের আলোচনাসভায় উপস্থিত ছিলেন।
ইসরাইল-ফিলিস্তিন সমস্যাকে দেখেন ইউরোপীয় লুঠ ও গণহত্যার পরম্পরা হিসেবে। তিনি বলেন, এ দেশে ১৭৫৭ সালের পর থেকে কর্পোরেট অর্থনীতি চালু হয়েছে।
অর্থনীতির ভিত দুর্বল হতে শুরু করেছে। কোভিড-পরবর্তী বিশ্বে দ্রুততার সঙ্গে বিশ্বের অর্থনৈতিক চিত্র বদলে যাচ্ছে। ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে মৌরসিপাট্টা ছিল, তার বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে বিশ্বে। নয়া শক্তিধর হিসেবে ইরান-রাশিয়া-চিন জোটের উত্থান ঘটছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। আর এই প্রেক্ষিতেই বিশ্বে ডি-ডলারাইজেশন চালু হয়েছে। এই ইতিহাস গবেষক আরও বলেন, ইউরোপীয় লুঠ ও গণহত্যা শুরু হয়েছিল পলাশির প্রান্তরে। আর সম্ভবত এর শেষ শিকার ফিলিস্তিন যেখানে আমেরিকার মদদে বোমাবর্ষণ চলছে। এদের রুখতে হলে অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নিতে হবে কর্পোরেটদের হাত থেকে। মনে রাখতে হবে, আমেরিকা আজকেও সাদাদের কলোনি। ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, ইরাকে আমেরিকা জেতেনি। হেরে পালিয়ে গেছে। ফিলিস্তিন থেকেও আমেরিকা ও তার দোসর ইসরাইল পালিয়ে যাবে।
পশ্চিমবঙ্গ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম বলেন, ফিলিস্তিনে যে নৃশংস অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞ চলছে, তার ভিডিয়োগুলো এক সময় ইন্টারনেট থেকে হারিয়ে যাবে। ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হবে যাতে কীভাবে গণহত্যা হচ্ছে তা আর বিশ্ববাসীর সামনে আসতে না পারে। ভারতীয় সংবিধানের ৫১ নং ধারার উল্লেখ করে এই প্রাক্তন আইএএস বলেন, আমাদের দেশের সংবিধানেও আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তাকে প্রমোট করার কথা বলা হয়েছে। এগুলি নাগরিকদের মৌলিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তাই আমাদের কর্তব্য যুদ্ধ বন্ধের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাওয়া।
জামাআতে ইসলামী হিন্দের প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি মুহাম্মদ নুরুদ্দীন বলেন, এই দেশের বড় অংশের মানুষ ইসরাইলের পক্ষে। একশ্রেণির মানুষ ভাবছে ইসরাইল ফিলিস্তিনের মুসলিমদের শেষ করবে। তারপর আমরা এখানকার মুসলমানদের শেষ করব। এ ক্ষেত্রে ভারতর্ষের জনমতকে ফিলিস্তিনের পক্ষে ঘোরানোর চেষ্টা করতে হবে। শুধু মুসলিম সম্প্রদায় নয়, অন্য সম্প্রদায়ের মানুষকেও সঙ্গে নিয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতে হবে।
আমানত ফাউন্ডেশনের কর্ণধার মুহাম্মদ শাহ আলম প্রশ্ন তোলেন, এটা কোন ধরনের যুদ্ধ? কোন ধরনের সভ্যতা? শিশুদের মারছে, হাসপাতাল গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। অথচ বিশ্ব-মোড়লরা কিছু করছে না। উজমা আলম বলেন, এই ধরনের হতাকাণ্ড ঘৃণ্য। ফিলিস্তিনে কোনও যুদ্ধ হচ্ছে না। ইসরাইলি অপারেশন চলছে যাতে শিশু-মহিলাদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে।
অধ্যাপক মির রেজাউল করিম বলেন, পশ্চিমা বিশ্ব আসলে ফিলিস্তিনের ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা করছে। একজন আক্রমণ করছে, একজন আত্মরক্ষা করছে। আরেকজন ‘দাদা’ অর্থাৎ আমেরিকা হাততালি দিচ্ছে। এটা ইহুদি-মুসলিম বিষয় নয়। অত্যাচারীর বিরুদ্ধে আমরা জমায়েত হয়েছি। অধ্যাপক সাইদুর রহমান জানান, ইসরাইল তার অতীত ইতিহাসকে বিকৃত করে মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়াচ্ছে।
এদিনের আলোচনাসভাটি শুরু হয় মুহাম্মদ মুরসালিমের কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে। আয়োজক সংগঠন মুসলিম কাউন্সিল অফ বেঙ্গলের সম্পাদক অধ্যাপক ড. মানাজাত আলি বিশ্বাসের সমাপ্তি ভাষণের মধ্য দিয়ে সভার সমাপ্তি ঘটে। অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সমাজসেবী মুস্তাফিজ হাশমি, লেখক ও হকার-কারিগর সংগঠনের সংগঠক অত্রি ভট্টাচার্য, অ্যাডভোকেট রিজওয়ানা, চা বাগানের প্রাক্তন ম্যানেজার মুহাম্মদ আলি হাসান, সাংবাদিক শাহরিয়ার হুসেন, হায়দার হোসেন, সাহিত্যিক সেখ আবদুল মান্নান, জি এম আবুবকর, ডব্লিউবিসিএস আধিকারিক মুদাসসর নজর প্রমুখ।