আহমদ হাসান ইমরানঃ চলে গেলেন বেগম মরিয়াম আযীয। ছিলেন বরেণ্য লেখক ও নজরুল বিশেষজ্ঞ আবদুল আযীয আল আমানের যোগ্য সহধর্মীনী। সব থেকে বড় কথা– কিছুদিন আগে ভারত ভাগ হয়েছে। দেশভাগজনিত অস্থিরতার মধ্যে রয়েছেন এপার বাংলার মুসলিম সমাজ। দু-একজন ছাড়া বরেণ্য লেখক– সম্পাদক এবং সবক্ষেত্র থেকেই শিক্ষিত ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা চলে গেছেন ওপার বাংলায়। বিরাট এক শূন্যতা বিরাজ করছিল এপার বাংলার মুসলিমদের মধ্যে। সেই সময় বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে মুসলিম সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতার হাল ধরে ছিলেন এই দম্পতি। আর তাদের এই কাজ এপারে থেকে যাওয়া মুসলিমদের সাহস জুগিয়েছিল। সব থেকে বড় কথা হচ্ছে– জনাব আবদুল আযীয আল আমান ও তাঁর সহধর্মীনী বেগম মরিয়াম আযীয পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করে সাহিত্য ক্ষেত্রে মুসলিম অস্তিত্বকে সেই সময় টিকিয়ে রেখেছিলেন। আর তাঁদেরকে কেন্দ্র করে সেই দুঃসময়ে গড়ে উঠেছিল একটি শক্তিশালী সাহিত্যিক বলয়। দু-একজনের নাম করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। আবদুল রাকিব– সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ– অধ্যাপক নূরুল ইসলাম– আবু আতাহার– আবদুল জব্বার প্রমুখ।
এই দম্পতি সমানভাবে আগ্রহী ছিলেন বাংলার মুসলিম নারীদের জাগরণেও। তাই বেগম মরিয়াম আযীযকে সম্পাদিকা করে বের হয় মহিলাদের জন্য পত্রিকা ‘বেগম’। নানা কারণে পত্রিকাটি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কিন্তু সম্ভবত বেগম-এর মোট ১১ বা ১৩টি সমৃদ্ধ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল– যা বাংলার মুসলিম নারীদের ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করে।
তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল যতদূর মনে পড়ে আমার বিয়ের পর। আমার লেখা পড়ে জনাব আবদুল আযীয আল আমান সাহেব আমাকে ভালবাসতেন। অসমের নওগাঁতে আমার বিয়ে হয়েছিল এবং পরবর্তীতে কলকাতার পার্ক সার্কাসে চার্চ অফ ক্রাইস্ট দ্য কিং-এ আমার ওয়ালিমার সময়ও কোনও এক কারণে তাঁরা যোগ দিতে পারেননি– সময়টা ছিল ১৯৮৮। বিয়ের প্রায় মাসখানেক পর এই দম্পতি হঠাৎই হাজির হলেন আমার ঝাউতলা রোডের ফ্ল্যাটে। সেই তাঁর সঙ্গে আমার ও আমার স্ত্রী ইয়ামিনের কথা বলার সুযোগ হল। আমাদেরকে উপহার দিল তাঁর বিখ্যাত বই ‘কাবার পথে’। আমরা এই দম্পতির হঠাৎ উপস্থিতিতে আপ্লুত হলাম। তখন মোবাইল ফোনের ততটা চলছিল না। তাই হয়তো খবর দিতে পারেননি। আমার স্ত্রী ইয়ামিন তাৎক্ষণিকভাবে তাঁদের আপ্যায়নের যে ব্যবস্থা করলেন তা মরহুম আবদুল আযীয আল আমানের খুবই ভাল লেগেছিল। নিজ মুখে বললেনও সে কথা।
এরপর আমার বোন মালেকা আলমের বিয়েতেও তিনি সস্ত্রীক উপস্থিত হয়েছিলেন। আরও তিন-চারবার মরিয়াম আযীযের সঙ্গে দেখা ও কথা হয়েছে। ধীরে ধীরে তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্য মনিরুল আযীয এবং মিরাজুল আযীযের সঙ্গেও পরিচয় হয়। আবদুল আযীয সাহেবের ইন্তেকালের পর আমি তাঁর স্ত্রী মরিয়াম আযীযের একটি সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছিলাম। তাঁর পুত্রদের অনুরোধে তিনি রাজিও হয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠেনি। সঠিক যোগাযোগের অভাবেই ছিল এর প্রধান কারণ।
মনে পড়ে আমার বন্ধু ও ছোটভাই নাইমুল হক শিশু-কিশোরদের নিয়ে অনুষ্ঠান করতে ভালবাসতেন। ২০০৯ সালে সে আমাকে ধরে বসল নলবনের সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে একটি পিকনিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে হবে। আমি ও নাইমুল স্থির করলাম– যদি এই অনুষ্ঠানে আমাদের শ্রদ্ধেয়া বেগম মরিয়াম আযীযকে কোনওভাবে আনা যায়– তবে তা ছোট-বড় সবাইকে অনুপ্রাণিত করবে। হাজির হলাম তাঁর ম্যাকলয়েড স্ট্রীটের বাড়িতে। ‘ইমরান এসেছে’ শুনে দেখা করলেন তিনি। আমরা তাঁকে বললাম যে– আপনাকে এই অনুষ্ঠানে অবশ্যই যেতে হবে। তিনি বললেন– আমি তো এখন বাইরে কোনও অনুষ্ঠানে যাই না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে রাজি করানো সম্ভব হল। তিনি এলেন। ওই অনুষ্ঠানে অন্যান্য বিশিষ্টদের মধ্যে ছিলেন সাংবাদিক-সম্পাদক অঞ্জন বসু– আরবি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক বদিউর রহমান– নাসিরউদ্দীন– মাওলানা শাহজাহান এবং কলকাতা ও আশপাশের বেশ কিছু আগ্রহী ও বিশিষ্ট মুসলিম পরিবার। আমরা সেখানে এক ছোট অনুষ্ঠানে তাঁর হাতে একটি স্মারক তুলে দিলাম। ছোট বক্তব্যে তিনি শালীনতাপূর্ণ সাহিত্য ও সংস্কৃতির কথা বললেন। ছোট ছেলে-মেয়েদের উপযুক্ত তালিম-তরবিয়তের উপরও জোর দিলেন। সেই দিনটির স্মৃতি চিরকাল আমার হৃদয়ে আঁকা থাকবে।
তারপর পারিবারিক কোনও একটি বিষয়ে তিনি আমাকে বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আমিও তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম। তাঁর ছেলে বিশেষ করে মনিরুলকে আমি বলতাম– মায়ের প্রতিশ্রুত সাক্ষাৎকারের কথা। সাক্ষাৎকারটি নিতে পারলে হয়তো সেসব দিনের অনেক কথাই জানা যেত। কিন্তু তাঁর শরীর খারাপ ও অন্যান্য কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। শেষদিকে তাঁর ছেলে বলেছিলেন– আম্মা ইদানিং অনেক কথাই ভুলে যাচ্ছেন।
২৭ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যুর দিনেই কাকতালিয়ভাবে তাঁর ছেলে মনিরুল আমার ফ্ল্যাটে এসেছিলেন তাঁর কন্যার বিবাহের দাওয়াত দিতে– তখন বেলা সাড়ে ১১টা। স্বাভাবিকভাবেই আম্মার কথা উঠে এল। বললেন– এখন শারীরিকভাবে আম্মা অনেকটাই সুস্থ। কিন্তু সেদিন মাগরিবের সময় তিনি হঠাৎই চলে গেলেন। মনিরুল বলল– আমি বাড়িতে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎতের কথা বললাম। আম্মা মাগরিবের সময় ভাই ও ভাবিকে বললেন– আমি নামায পড়ব– ওজুর ব্যবস্থা কর। ওজু করে এসে অবশ্য তাঁর আর মাগরিবের নামায আদায় করা হয়ে ওঠেনি। হঠাৎ দু-তিনবার হেঁচকি তুলে তিনি আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেলেন।
মনিরুলকে কি বলে সান্তনা দেব– বুঝতে পারছিলাম না। আমি নিজেই টেলিফোনে কেঁদে ফেললাম। সমাজের এক রত্ন চলে গেলেন। তবে মৃত্যুর আগে খুব একটা কষ্ট পাননি। এটাই আমাদের সান্তনা।