সেখ জামাল, পুবের কলম ওয়েবডেস্ক: শুক্রবার সন্ধ্যায় শিহরিত হওয়া বালেশ্বরের ট্রেন দুর্ঘটনার একজন ভুক্তভোগী দক্ষিণ ২৪ পরগনার ছড়নেখালি গ্রামের বাসিন্দা রবিন নাইয়া। মৃত ভেবে মৃতের সারিতে ফেলে রাখা রবিন কপাল জোরে উঠে এসেছেন জীবিতদের সারিতে। তবে তাঁর কোমর থেকে নিচের অংশ একেবারে অকেজো। দুই পা ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গিয়েছে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক ওয়ার্ডে। রবিন নাইয়া (৩৫) গ্রামের অন্য ৭ জনের সঙ্গে দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে করমণ্ডল এক্সপ্রেসে করে যাচ্ছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশে। সেখানে চাষের কাজে বীজ রোপণের কাজ করেন সকলে। একটা বগির মধ্যেই ছিলেন সকলে। হঠাৎ দুর্ঘটনায় একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। দুর্ঘটনার পর কয়েক মুহূর্ত সকলেই হতভম্ব অন্ধকারে। ওই বগির এক প্রত্যক্ষদর্শী সিঙ্গুরের বাসিন্দা প্রসেনজিৎ মাঝি বলেন, ‘প্রচণ্ড গতিতে থাকা ট্রেনটি হঠাৎ বিশাল শব্দ করে লাইনের বাইরে চলে যায়। এরপর বিদ্যুতের লাইট বন্ধ, চারিদিকে অন্ধকার। পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যেই সকলেই প্রচণ্ড ধাক্কায় এক জায়গায় জড়ো হয়ে গেলাম। ঘটনার পর আমি জ্ঞান হারাই। পরে চেতনা ফিরলে কোনওভাবে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলাম দুমড়ে যাওয়া ট্রেনের বগি থেকে বহুযাত্রী ভেতর থেকে নিজেদের শরীরটাকে টেনে-হেঁচড়ে বের করার চেষ্টা করছেন। চোখের সামনে তাদের অনেককেই আর্ত চিৎকার করে মারা যেতে দেখলাম। দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ পরে উদ্ধারকারী গ্রামবাসীরা হাজির হয়েছিলেন।
তাঁরা অনেককেই উদ্ধার করেন। যাঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন সংজ্ঞাহীন। এমন অনেককেই রক্তাক্ত নিথর দেখে মৃতদেহের সারিতে সরিয়ে রাখা হচ্ছিল। এমন অনেক চাপা পড়াদের ভিড়ে সংজ্ঞা হারানো রবিন নাইয়াও ছিলেন। রবিনের পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, অনেক রাতে বগি সরিয়ে তাকে নিথর অবস্থায় চাপা পড়াদের মধ্য থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। তাঁর নিথর শরীর মৃতদের সঙ্গে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। জ্ঞান ফিরে তিনি নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলেন মৃতদের ভিড়ে। হালকা চোখ খুলে রবিন দেখতে পেয়েছিলেন পাশে একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। মৃতের ভিড় থেকে হঠাৎ দুই হাত বাড়িয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক উদ্ধারকারীর পা জড়িয়ে ধরেছিলেন রবিন। ওঠার ক্ষমতা হারিয়েছিলেন তিনি। পা ধরে কাতর অনুরোধ ‘আমি মারা যায়নি। আমাকে জল দিন, বাঁচান।’
হতভম্ব উদ্ধারকারীরা তাঁকে সেখান থেকে সরিয়ে আহতদের সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সে তোলে। এরপরে হাসপাতাল ঘুরে বর্তমানে তার স্থান হয় মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। কোমর থেকে প্রায় অচেতন তার নিচের অংশ। দুই পা ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গিয়েছে। কথা বলার ক্ষমতা প্রায় নেই। রবিনের মামা মানবেন্দ্র সর্দার খবর পেয়ে হাসপাতালে কথা বলে পরিস্থিতি জানতে পারে তার। তিনি বলেন,‘রবিন মারা গিয়েছে বলে মনে করে ওকে মৃতদেহের সারিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। জ্ঞান ফিরতে উদ্ধারকারীদের পা জড়িয়ে ধরে, জল চায় সে। ওরা মোট আটজন ছিল, তার মধ্যে ৫ জন মারা গিয়েছে। একজন নিখোঁজ।’ ট্রেন দুর্ঘটনার এমন মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা মানবেন্দ্র সর্দারদের পরিবার আগেও ছিল। মানবেন্দ্র জানান, ‘আমার নিজের দাদা রাজকুমার সর্দার দিল্লিতে কাজে যাওয়ার সময় জ্ঞানেশ্বরী অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। সেবারও বেঁচে গিয়েছিলেন দাদা। বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছিল ওই দুর্ঘটনায় অনেককেই মারা গিয়েছিলেন। দাদাকেও মারা গিয়েছে মনে করেছিল উদ্ধারকারী গ্রামবাসীরা। মৃতের সারিতে রাখা হচ্ছিল তাঁকে। দাদা তা বুঝতে পেরে সরে পড়ে। শরীরে শক্তি ছিল না। জঙ্গলে পড়েছিল দু’দিন। পরে তাঁকে উদ্ধার করেছিলাম। ফলে ট্রেন যাত্রা নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ।’