বিপাশা চক্রবর্তী, কলকাতাঃ বারাসতের একরত্তি মেয়েটার স্বপ্ন শুরু হয়েছিল ক্যারাটে দিয়ে। আর সেই স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তার বাবা-মা।
মেয়ে তাই হাত-পায়ে যদি চোট লাগে, ময়দানে নেমে যদি মেয়ে না পারে, এসব চিন্তা কখনও ভিড় করে আসেনি অরিঞ্জিতার বাবা অরিন্দম দে’র মাথায়। উল্টে বরং মেয়ের স্বপ্নকে সত্যি করে তুলতে স্ত্রীয়ের সোনার গয়না বেচে অরিঞ্জিতার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে কন্যার পাশেই আছেন তিনি।
মাত্র ১০ বছর বয়সেই অরিঞ্জিতা হয়ে উঠেছে বারাসতের গর্ব। অরিন্দম দে ও নিবেদিতা দে’র সন্তান অরিঞ্জিতার ঝুলিতে সব মিলিয়ে ৪৫টা স্বর্ণ পদক, ১১টা সিলভার, ৭টা ব্রোঞ্জ। অরিঞ্জিতার বয়সি আর পাঁচটা বাচ্চা যখন পুতুল খেলায় ব্যস্ত তখন থেকে অরিঞ্জিতা ব্যস্ত থেকেছে তার কঠোর অনুশীলনে। ভোর থেকেই শুরু হয় তার লড়াই। যা প্রতিদিন চলে নিয়ম করে।
কঠোর অনুশীলনে ব্যস্ত অরিঞ্জিতা
মাত্র ৮ বছর বয়সেই বাংলার হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সাব-জুনিয়র ক্যারাটেতে সোনা জিতে নেয় অরিঞ্জিতা। এর পর জাতীয় চ্যাম্পিয়ন অরিঞ্জিতা দেশের জন্য কমনওয়েলথ কাপ-এ অংশগ্রহণ করে। ২০১৮ সালে সাউথ আফ্রিকার ডারবানে আয়োজিত কমনওয়েলথ ক্যারাটে কাপ-এ কাতাতে সিলভার পায় অরিঞ্জিতা ও দলগত ভাবে ব্রোঞ্জ। ২০১৯ এ মাত্র ১০ বছর বয়সে ওয়ার্ল্ড ইয়ুথ কাপ(ডব্লু কে এফ) সিলভার পদক জিতে নেয় সে।
তবে ক্যারাটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ২০১৯ সাল থেকে চলছে ফেন্সিং-এর অভ্যাস। তবে আমাদের দেশে এখনও সেভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি ফেন্সিং।সকলের আশা প্রতিযোগীদের হাত ধরে হয়তো ঘুরে দাঁড়াতে পারে ফেন্সিং।
ফেন্সিং-এ জাতীয় স্তরের খেলোয়াড়
কোচ সন্তোষ পাণ্ডে’র সঙ্গে অরিঞ্জিতা
২০২০ সালে ফেন্সিং-এ নেতাজি সুভাষ স্টেট গেমস (আন্ডার-১৭ ক্যাটাগোরিতে) -ব্রোঞ্জ মেডেল পায় অরিঞ্জিতা। ফেন্সিং-এ তার কোচ জাতীয় স্তরের খেলোয়াড় সন্তোষ পাণ্ডে। ফেন্সিং-এ ২০২১ সালেই কটকে আয়োজিত জাতীয় সাব জুনিয়র (আন্ডার ১৪) অংশগ্রহণ করে সকলের নজর কেড়ে নেয় অরিঞ্জিতা দে।
ক্যারাটে, ফেন্সিং ছাড়াও অরিঞ্জিতা ভালোবাসে সাঁতার।
বারাসতের ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়াল হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী অরিঞ্জিতা পড়াশোনা আর কঠোর অনুশীলনের মাঝে কার্টুন দেখতে ভালোবাসে। এছাড়াও মায়ের হাতের স্পাইসি ফুড পছন্দ তার। স্কুলেরও সকলের প্রিয় ছাত্রী অরিঞ্জিতা। পাশে রয়েছেন স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল, ভাইস প্রিন্সিপ্যাল থেকে চেয়ারম্যান।
তবে খেলাধুলো ছাড়াও অরিঞ্জিতা একজন পশুপ্রেমী। ইতিমধ্যেই রাস্তার পাঁচটি কুকুরের দায়িত্ব নিয়েছে সে। রাস্তায় পড়ে থাকা কুকুরদের তুলে নিয়ে এসে সেবা যত্নে সারিয়ে তোলে অরিঞ্জিতা।
বাবা অরিন্দম দে
মা নিবেদিতা দে’ র সঙ্গে অরিঞ্জিতা
অরিন্দমবাবু ও নিবেদিতাদেবীর কথায়, মেয়ের স্বপ্নপূরণে সব সময় পাশে রয়েছেন তারা। তবে সরকারের তরফে সাহায্য পেলে খুব ভালো হয়। অরিন্দমবাবু জানান, তিনি নিজে একজন বেসরকারি চাকুরে। অনেক সময় ধারদেনা করেই মেয়েকে প্রতিযোগিতায় পাঠাতে হয়। স্ত্রীয়ের গয়নাও সব বেচে দিতে হয়েছে। তবে যত বাধাই আসুক না কেন, মেয়ের এই লড়াই থেমে থাকবে না বলেই জানিয়েছেন আত্মবিশ্বাসী অরিন্দমবাবু।
আমাদের ভারতের মতো দেশে ক্রিকেট এবং ফুটবলের মতো প্রথম সারির খেলার জৌলুসে যখন ফিকে পড়ে যায় একাধিক বেনামি খেলা, তখন ফেন্সিং এর মতো চ্যালেঞ্জিং একটা খেলাকে নেশা হিসাবে বেছে নেওয়াটাই বিশাল ব্যাপার। তামিলনাড়ুর চেন্নাইয়ের বাসিন্দা ২৭ বছর বয়সি চাদালাভাদা আনন্ধা সুন্ধারারামান ভবানী দেবী ভারতকে পদক এনে দিয়েছেন। আমাদের সকলের শুভকামনা ও কুর্নিশ থাকল ছোট্ট অরিঞ্জিতার লড়াইকে।