ডা. মেহেদি হাসান মোল্লা: বেলা বাড়তেই রোজ হাসপাতালের এমারজেন্সিতে কিছু রোগীর ভিড় জমে যাদের বেশির ভাগই সারা শরীর দিয়ে অতিরিক্ত ঘাম বের হচ্ছে, খুব জোরে শ্বাস নিতে হচ্ছে। প্রেশার, সুগার চেক করলে দেখা যাচ্ছে দুটোই স্বাভাবিকের নিচে এবং শরীরের তাপমাত্রাও অনেকটা বেশি। অর্থাৎ এই আবহাওয়ায় সান স্ট্রোক বা হিট স্ট্রোকের সংখ্যা প্রায় চোখে পড়ে। এই তীব্র তাপপ্রবাহে প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছে স্কুল পড়ুয়া থেকে নিত্য পথচারীরা। বিশ্ব-উষ্ণায়নের কুফুল যে অদূর ভবিষ্যতে সবাইকে ভুগতে হবে সে বিষয়ে বিজ্ঞানীরা আগেই নিশ্চিত করেছেন। আর তার ফলস্বরূপ উত্তরোত্তর ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি হবে এটাই ভবিতব্য। সুতরাং এই পরিস্থিতির বাইরে গিয়ে আমরা কিছু করতে পারব না বরং এখন আমাদের এই পরিবেশের সাথে কিভাবে মানিয়ে চলতে হবে সেই পাঠ সবাইকে শিখে নিতে হবে।
প্রথমে জানতে হবে হিট স্ট্রোক কী?
আমরা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বা নিজেদের স্মার্ট ফোনের গুগুল ওয়েদার অ্যাপের মাধ্যমে জেনে গেছি বিভিন্ন জেলাতে তাপপ্রবাহ চলছে। হাওয়া অফিস বলছে আগামী কয়েক দিনে অন্তত বৃষ্টির দেখা নেই সাথে চলবে এমন তাপপ্রবাহ। এই বাইরের পরিবেশের অত্যাধিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি যখন শরীরের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, চিকিৎসাশাস্ত্র অনুযায়ী শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে গেলে তাকে হিট স্ট্রোক বলে। স্বাভাবিক অবস্থায় আমাদের মস্তিষ্কের তাপ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের নির্দেশে রক্তের মাধ্যমে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয়। কোনও কারণে শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে ত্বকের রক্তনালি প্রসারিত হয়ে অতিরিক্ত তাপ পরিবেশে ছড়িয়ে দেয় এবং ঘামের মাধ্যমেও শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু প্রচণ্ড গরম ও আর্দ্র পরিবেশে বেশি সময় অবস্থান বা পরিশ্রম করলে শরীরের স্বাভাবিক তাপ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অকেজো হয়ে যায়। এতে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত বিপদসীমা ছাড়িয়ে যায় এবং হিট স্ট্রোক দেখা দেয়। যদিও এই হিট স্ট্রোক হল সর্বোচ্চ পর্যায়। তবে এই পর্যায়ে পৌঁছানোর আগে শরীরে আরও কিছু ধাপ পেরোতে হয় যেগুলোর মাধ্যমে আগে থেকে সচেতন হওয়া যায়।
কি কি লক্ষণ দেখে বুঝবেন আপনি হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে চলেছেন?
তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেহে নানা রকম প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। প্রাথমিকভাবে শরীর কিছু সিগনাল দেয় আমাদের যাকে বলে হিট ক্র্যাম্প। এই সময়ে শরীরের মাংসপেশিতে ব্যথা হয়, শরীর দুর্বল লাগে, গা ঝিমঝিম ভাব হয় এবং প্রচণ্ড পিপাসা পায়। এর পরের ধাপে হিট এক্সহসশনে exhaustion) দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস, মাথা ব্যথা, ঝিমঝিম করা, বমিভাব, অসংলগ্ন আচরণ, মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার মতো ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়। এই দুই ক্ষেত্রেই কিন্তু শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ঠিক থাকে এবং শরীর অত্যন্ত ঘামতে থাকে। সুতরাং এই অবস্থায় আপনি অবহেলা করে যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেন তাহলে কিন্তু হিট স্ট্রোকের সম্ভাবনা অনেকটা বেড়ে যায়।
হিট স্ট্রোকের লক্ষণগুলো কি?
১.শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যায়।
২.ত্বক শুষ্ক ও লালচে হয়ে যায়। ঘাম বন্ধ হয়ে যেতে পারে
৩. রোগী খুব দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়
৪. নাড়ির স্পন্দন ক্ষীণ ও দ্রুত হয়।৫. রক্তচাপ কমে যায়।
৬. খিঁচুনি, মাথা ঝিমঝিম করা, অস্বাভাবিক আচরণ
৭. প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায় ও হলুদ রঙের হওয়া
৮. রোগী শকে চলে যেতে পারে। এমনকি পড়ে গিয়ে সাময়িক অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।
হিট স্ট্রোক কাদের বেশি সম্ভাবনা?
প্রচণ্ড গরমে ও আর্দ্রতায় যারা বেশি সময় ধরে গরমে কাজ করছেন যে-কারও হিট স্ট্রোক হতে পারে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হিট স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যেমন—
১. শিশু ও বৃদ্ধদের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কম থাকায় হিট স্ট্রোকের সম্ভাবনা অনেক বেশি।
২. যারা দিনের বেলায় প্রচণ্ড রোদে কায়িক পরিশ্রম করেন, তাদের হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। যেমন— কৃষক, শ্রমিক, রিকশাচালক, দিনমজুর, কন্সট্রাকশন লেবার ইত্যাদি।
৩. শরীরে ডিহাইড্রেশন হলে অর্থাৎ জল কম পান করলে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে ও যাদের শরীরে অত্যাধিক ঘামের মধ্যে জল ও খনিজ বেরিয়ে যায়।
৪. কিছু কিছু ওষুধ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায় বিশেষ করে যারা ডাইইউরেটিক গ্রুপের ওষুধ খান তাদের শরীরে জলের ঘাটতি দেখা দেয়।
হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচার উপায়:
১. যেহেতু আমরা কারণ সম্পর্কে জেনে গেছি সেহেতু প্রতিরোধের উপায় আমাদের সহজে বোধগম্য হবে। গরমে যেহেতু ঘামের মাধ্যমে জলের পরিমাণ কমে যাচ্ছে সেহেতু প্রচুর পরিমানে জল খেয়ে শরীরকে হাইড্রেট করতে হবে। ইলেক্ট্রোলাইট ঘাটতি মেটাতে জলের সাথে ও.আর.এস মিশিয়ে নিতে হবে। নাহলে ঘরোয়া পদ্ধতিতে ৪ টেবিল চামচ চিনি ও ১ চামচ লবন এক লিটার জলে মিশিয়ে ব্যাগে রাখুন। ঘণ্টায় ঘণ্টায় এই জল পান করতে থাকুন। জলের পাশাপাশি ফলের জুস (লেবু, বেল, তরমুজ) খেতে পারেন। কিডনি ও প্রেশারের রুগীরা চিকিৎসকের পরামর্শ মত জল পান করুন।
২. পোশাক পরুন ঢিলেঢালা, সুতির কাপড়ের ও হালকা রঙের। গরমে আঁটোসাটো পোষাক থেকে শরীরকে রেহাই দিন। ফুল স্লিভ জামা বা কাপড় ব্যবহার করুন যাতে শরীরের বেশিরভাগ অংশ ঢাকা থাকে। নরম কাপড়ের অন্তর্বাস অবশ্যই ব্যবহার করুন। যাতে দ্রুত ঘাম শুষে নিয়ে আপনার শরীরকে ঠাণ্ডা রাখবে।
৩. বাইরে বেরোলে অবশ্যই ছাতা, টুপি,সানগ্লাস ব্যবহার করুন। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ঠান্ডা জল দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিন। ওয়েট ওয়াইপ রাখতে পারেন সাথে।
৪. ত্বক অনুযায়ী সঠিক সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন। যাদের ত্বক বেশি সেন্সিটিভ প্যারাবেন কিংবা অক্সিবেনজোন জাতীয় কেমিক্যাল যুক্ত সানস্ক্রিন এড়িয়ে চলুন। টাইটানিয়াম ডাইঅক্সাইড বা জিঙ্ক অক্সাইড জাতীয় উপাদান থাকা সানস্ক্রিন সেনসিটিভ ত্বকের জন্য উপকারী। সূর্যের তাপ থেকে ত্বককে রক্ষা করে এই উপাদানগুলি। যাদের ত্বকে বেশি তৈল যুক্ত তারা ওয়েল বেসড সানস্ক্রিন এড়িয়ে চলুন এবং যাদের ড্রাই স্কিন বা শুষ্ক ত্বক তাঁরা অবশ্যই ময়শ্চারাইজিং সানস্ক্রিন ব্যবহার করবেন। বাইরে যাওয়ার অন্তত ৩০ মিনিট আগে মেখে নিতে হবে। সম্ভব হলে ২ ঘন্টা বাদে আরও একবার মেখে নিতে হবে। বিজ্ঞাপনের ঝুঁকিতে পড়ে অযথা উচ্চ (PF যুক্ত সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে যাবেন না। আমাদের এই পরিবেশে মোটামুটি (PF ৩০ যুক্ত সানস্ক্রিন যথেষ্ট। সঙ্গে দেখে নেবেন সেই সানস্ক্রিন আল্টাভায়োলেট -এ ও বি উভয় রশ্মিকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আছে কিনা।
৫. গরমের সময় ফাস্টফুডকে না বলুন। কেননা, এতে থাকা অতিরিক্ত লবন, তেল গরমে আপনার শরীরকে আরও বেশি ক্ষতি করবে। বাইরের খোলা খাবার থেকে বিরত থাকুন। ঘরোয়া হালকা খাবারে জোর দিন
৬. প্রচণ্ড গরমে শরীরে যাতে ঘাম না জমে তার জন্য সম্ভব হলে হালকা রুমাল জলে ভিজিয়ে গা মুছে নিন। বাড়িতে থাকলে একধিকবার স্নান করুন।
৭. হঠাৎ বাইরে থেকে এসে এসি তে বসবেন না বা হঠাৎ এসি থেকে বেরিয়ে অতিরিক্ত গরমে যাবেন না।
৮. গরমে চা, কফি, কোল্ড ড্রিঙ্কস খাবেন না।
৯. দীর্ঘক্ষণ প্রখর রোদে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। এতে রক্তচাপ কমে যেতে পারে।
লেখক মেডিকেল অফিসার,
প্রীতিময়ী রুরাল হসপিটাল, পলাশিপাড়া, তেহট্ট, নদিয়া
ফোন- ৯৭৩২৩৯৭৭৬৩