আহমদ হাসান: একে তো বন্দে ভারত দ্রুতগামী ট্রেনের অভিজ্ঞতা, অন্যদিকে গরম চা আস্বাদনের স্পৃহা। কিন্তু ঠোঁট ও চায়ের কাপের মধ্যে যে ফারাক, তা অনেক সময় পূরণ হয় না বলে একটি ইংরেজি প্রবাদ আছে। বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের সওয়ারি এক যাত্রী চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে থমকে গেলেন। খবরটি ইতিমধ্যেই ভাইরাল হয়েছে। তবে বিষয়টি কী?
ওই যাত্রী হঠাৎ দেখেন, চায়ে ডোবানো টি-ব্যাগের স্টিকারে রয়েছে ‘হালাল’ শব্দ। আর যায় কোথায়! তিনি খাবেন কি! বরং ক্ষেপে লাল হয়ে গেলেন। কারণ, ওই ‘হালাল’ শব্দটি। তিনি গাঁটের পয়সা খরচ করে নরেন্দ্র মোদিজির চালু করা বন্দে ভারতে টিকিট কেটেছেন। কাজেই তিনি তো যাত্রী হিসেবে শতেক ক্ষমতার অধিকারী! তৎক্ষণাৎ ডেকে পাঠালেন বন্দে ভারতের ক্যান্টিনের আধিকারিককে।
প্রশ্ন করলেন, চায়ের মধ্যে ‘হালাল’ স্টিকার কেন? তাঁর তো সব্বনাশ হয়ে গেল! কারণ, তিনি শ্রাবণ মাসে পুজো দিতে যাচ্ছেন। আর তাঁর চায়ের কাপে ‘হালাল’ স্টিকার! অন্য যাত্রীরাও নাকি তাঁর পক্ষ নিয়ে শোরগোল সৃষ্টি করেন। রেলের ওই আধিকারিক আমতা আমতা করে ব্যাখ্যা দিতে থাকেন। তাঁরা একটি ব্র্যান্ডেড কোম্পানি থেকে চায়ের ব্যাগ কিনেছেন। বাগানে জন্মানো এই চা সম্পূর্ণ ভেজ। অর্থাৎ কি না নিরামিশ। কিন্তু ওই যাত্রী ও তাঁর সহযোগীরা তা মানবেন কেন? তাঁদের প্রশ্ন, কী করে এই ‘হালাল’ মাল বন্দে ভারতে ওঠা ট্রেনযাত্রীদের মতো মানুষের সামনে পেশ করা হয়, ক্যান্টিনের আধিকারিক লিখিত না হলেও মৌখিক প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হন ‘অউর কভি ইসতরাহ গুনাহ নেহি হোগা’। না না, গুনাহ আরবি শব্দ হলেও চলবে। কারণ, খোদ মোদিজি মণিপুর নিয়ে বলতে গিয়ে স্বজ্ঞানে বলে ফেলেছেন ‘কোই গুনাহগার-কো বখশ্ নেহি কিয়া জায়েগা।’ ওই আরবি শব্দটি খোদ মোদিজির মুখ-নিঃসৃত।
যাই হোক, এখন ভাবতে হবে আমাদের দেশে সম্প্রদায় সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘৃণার পরিমণ্ডল কী পরিমাণ বিস্তৃতি হয়েছে, আর তা কতটা গভীরে শিকড় গেড়েছে।
ওই ‘হালাল’ শব্দটি দেখে কেন যাত্রীপ্রবর এত ক্ষিপ্ত হলে, কারণ, সম্ভবত এই ইদানীং ভারতে যা কিছু মুসলিম এবং আরবি-ফারসি শব্দ সংবলিত শহর, স্টেশন সবকিছুকে উৎপাটিত করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু এক সময় আমাদের এই দেশে পুজোর সামগ্রী, ফুল, প্যান্ডেল সবই জোগান দিতেন মুসলিমরা। এখনও কিছু কিছু জায়গায় এই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।
‘হালাল’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘অনুমোদনযোগ্য’ বা ‘পারমিসিবল’। এর উলটো শব্দ হচ্ছে, ‘হারাম’। এর অর্থ ‘নিষিদ্ধ’। এখন ‘হারাম’ স্টিকার লাগানো বিভিন্ন পণ্য কোটি কোটি বিলিয়ন ডলারের বিজনেস করছে। আর ‘হালাল’ শব্দটি শুধু মাংসের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় না। ‘হালাল’ স্টিকার ইদানীং লাগানো হচ্ছে ওষুধ, প্রসাধনী দ্রব্য বিভিন্ন ধরনের পানীয় দ্রব্য, পোশাক এবং আরও অনেক ক্ষেত্রে। এমনকী বেশকিছু কোম্পানি ‘হালাল ট্যুর’ও শুরু করেছে। অর্থাৎ এই ট্যুরে শুধুমাত্র স্বামী-স্ত্রী এবং ফ্যামিলির সদস্যরা যোগ দিতে পারবেন। তাঁদের জন্য ‘হালাল’ স্থানে পরিদর্শন ও বিনোদনের ব্যবস্থা থাকবে।
ইউরোপ, আমেরিকাতেও ‘হালাল’ স্টিকার লাগানো খাদ্যদ্রব্য প্রসাধনী এবং পোশাক-পরিচ্ছদ বিরাট জনপ্রিয়তা পেয়েছে, পেয়েছে বিজনেসও।
একটু খোঁজ নিয়ে দেখলে বন্দে ভারতের ওই যাত্রী হয়তো দেখতে পেতেন ‘হালাল’ স্টিকার লাগানো ওই চা কোম্পানির মালিক কোনও মাড়োয়ারি, গুজরাতি কিংবা টাটা গ্রুপের মতো কোনও কোম্পানি। আর তাঁদেরও তো বিশ্বজুড়ে ব্যবসা করতে হয়। তাই তাঁরাও তাঁদের পণ্য-দ্রব্যে ‘হালাল’ সার্টিফিকেশন লাগাচ্ছেন। শুধুমাত্র মুসলিম বিদ্বেষকে সম্বল না করে ওই যাত্রী ইসলামফোবিয়ার ভিন্ন বিষয় খুঁজে বের করার ব্রত গ্রহণ করতে পারেন। বন্দে ভারত কান্ডে প্রশ্ন উঠেছে, এই ধরনের সম্প্রীতি আর কতদিন বেঁচে থাকবে?