বিশেষ সংবাদদাতা, বহরমপুর: কখনও গ্রামে গ্রামে, কখনও-বা ভিন রাজ্যে হকারি করে ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন বাবা। হকার বাবার সেই সন্তান আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। দরিদ্র বাবা-মায়ের হাড়ভাঙা উপার্জন অধ্যাপক করেছে মুর্শিদাবাদের মেধাবী সন্তান রবিউলকে।
শনিবার ওড়িশা রাজ্যের খ্যাতনামা রেভেন’শ্ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে যোগদান করেছেন রবিউল আনসারি। দৌলতাবাদ থানার দৌলতাবাদ গ্রামের খেটে খাওয়া পরিবারের ছেলে পাশের রাজ্যের কটকের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। রবিউল আনসারির এই সাফল্যে দৌলতাবাদ সহ গোটা মুর্শিদাবাদ জেলায় খুশির বার্তা ছড়িয়েছে। অধ্যাবসায় আর চেষ্টা থাকলে যে এভারেস্টও ছোঁয়া যায়, তা প্রমাণ করেছেন রবিউল আনসারি ওরফে মুন্না। হ্যাঁ, মুন্না নামেই দৌলতাবাদ রবিউলকে চেনে।
রবিউল আনসারির বাবা ইমাদুল আনসারি তেমন লেখাপড়া জানেন না। ছেলে যখন ভূগোলে অনার্স নিয়ে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় তখন ছেলের পড়ার খরচ যোগাতে হকারি শুরু করে বাবা। ডোমকল থানার বাজিতপুর থেকে শাঁখা কিনে বিক্রি করতে যায় ওড়িশা-বিহার-ঝাড়খন্ডে। দীর্ঘদিন ভিনরাজ্যে হকারি করে যা লাভ হয়েছে সেই টাকা পাঠিয়েছেন ছেলেকে। রবিউলের মা আঙুরা বিবি নিজে গামছা বুনে সেই গামছা বাজারে বিক্রি করে সংসার চালিয়েছেন। বাবা-মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল অধ্যাপক রবিউল আনসারি।
পাশের হাসানপুর হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করে মুর্শিদাবাদ শহরে নবাব বাহাদুর ইনস্টিটিউশনে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হয় সে। এখান থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ভূগোলে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয় আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ, এমফিল এবং পিএইচডি।
তারপর ওড়িশার উৎকল বিশ্ববিদ্যালয়ে গেস্ট লেকচারার হিসাবে দেড় বছর কাজ করেন। ওড়িশা পাবলিক সার্ভিস কমিশন আয়োজিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদের পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। নিজের পছন্দের কটকের রেভেন’শ বিশ্ববিদ্যালয়ে শনিবার যোগদান করেন। এই রেভেন’শ বিশ্ববিদ্যালয় আগে শুধুমাত্র কলেজ ছিল। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু এই প্রতিষ্ঠানেরই অন্তর্গত রেভেন’শ কলেজিয়েট স্কুলে ছাত্র ছিলেন।
রবিউল আনসারি জানিয়েছেন, আমার লক্ষ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা। পশ্চিমবঙ্গে দু’বার ইন্টারভিউ দিয়েছি। নিজের রাজ্যের ইন্টারভিউয়ের অভিজ্ঞতা খুব খারাপ। এখানে যোগ্যতার মূল্যায়ন হয় কি না আমার জানা নেই। আমার নাম,আমার বিশ্ববিদ্যালয়কেও বিদ্রুপ করা হয়। তাই ভিনরাজ্যের পরীক্ষায় বসে দ্বিতীয় স্থানে নাম বেরিয়েছে। সবকিছু যেন সুষ্ঠুভাবে হল। কম সময়ে কর্মস্থলে যোগ দিলাম। আমার এই সাফল্যের জন্য আমার বাবার পরিশ্রম,অবদান একশো ভাগেরও বেশি। আমার জন্য বাবা হকারি করতে গিয়ে ভিন্ রাজ্যে কারও দোকানের বারান্দায় ঘুমিয়েছে।
দোকান মালিক গভীর রাতে ঘুম থেকে তুলে বারান্দা থেকে রাস্তায় বের করে দিয়েছে। বাকি রাত রাস্তায় বসে কাটিয়েছে বাবা। তা সত্ত্বেও আমার প্রয়োজনের টাকা সঠিক সময়ে পাঠিয়েছেন। আমার জীবনের সবকিছু দিয়েও বাবার এই ঋণ শোধ করতে পারব না। রবিউলের বড় দাদা আনারুল আনসারি এখনও বাবার মতো হকারি করেন। ছোট ভাই আনজামুল আনসারি দৌলতাবাদ বাজারে একটা স্টেশনারি দোকান করেছেন। বাবা ইমাদুল আনসারিকে উমরাহেত পাঠিয়েছেন রবিউল আনসারি।
মা আঙুরা বিবি বলেন, আমার মুন্না ছোটবেলা থেকে পড়ায় ভাল ছিল। আমি ভোররাতে উঠে গামছা বোনার কাজ করতাম। আর মুন্নাকে ডেকে দিলে ভোররাতে উঠে আমার পাশে বসে পড়ত। ছেলে বাইরে যাওয়ার পর ওর বাবা খুব কষ্ট করে ছেলের জন্য টাকা জোগাড় করেছে। আর আমিও খেয়ে না খেয়ে গামছা বুনে সংসার চালিয়েছে। ছেলের এই সাফল্যে আমরা সবাই খুশি।