আহমদ হাসান ইমরান: প্রখ্যাত সাংবাদিক এবং কলামিস্ট শেখ সদর নঈম মঙ্গলবার সকাল ১০টার সময় বেলভিউ ক্লিনিকে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন… আমরা তো আল্লাহ্রই, আর আমাদের তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। মৃত্যুর সময় তাঁর পুত্র শেখ সদর সইফ ও শেখ মুহাম্মদ ফারহান উপস্থিত ছিলেন। দুই পুত্র ছাড়াও তাঁর স্ত্রী ইয়াসমীন নিগার বর্তমান রয়েছেন।
শেখ সদর নঈম মাত্র দিন কয়েক আগে বেলভিউ ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছিলেন। অবস্থা দেখে তাঁকে আইসিইউ-তে পাঠানো হয়। কিন্তু চিকিৎসা সত্ত্বেও পরিস্থিতির অবনতি হলে তাঁকে ভেন্টিলেটরে মাধ্যমে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যবস্থা করা হয়। মঙ্গলবার সকালে হঠাৎই শেখ সদর নঈমের হার্ট অ্যাটাক হয় এবং তিনি ইন্তেকাল করেন।
শেখ সদর নঈম ছিলেন একজন অগ্রণী বুদ্ধিজীবী। ইংরেজি, বাংলা এবং উর্দু ভাষাতে তিনি সমান দক্ষ ছিলেন। কর্মজীবনে শেখ সদর নঈম প্রথমে কলামিস্ট হিসেবে দ্য টেলিগ্রাফ, ইংরেজি স্টেটসম্যান ও এশিয়ান এজ-এ লিখতেন। এরপর তিনি ইংরেজি স্টেটসম্যান পত্রিকায় ইকোনমিক এডিটর হিসেবে যোগ দেন। পরে তিনি বাংলা স্টেটসম্যান পত্রিকায় দীর্ঘদিন সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। বাঙালি পাঠকদের উর্দু শায়েরীর স্বাদ দেওয়ার জন্য তিনি গুলজারের একটি বইয়ের বাংলা অনুবাদও করেন, যা সুখ্যাতি পেয়েছে।
দৈনিক পুবের কলম পত্রিকার সঙ্গেও তাঁর ছিল গভীর সম্পর্ক। বাংলা স্টেটসম্যান পত্রিকার কাজ ছেড়ে দেওয়ার পর তিনি পুবের কলম পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদকমণ্ডলীর একজন হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর লেখা নিয়মিত পুবের কলম-এ প্রকাশিত হত। তিনি মাঝখানে একবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। বাড়ি ফিরে আসার পর পুবের কলম থেকে তাঁকে বলা হত, আপনি এখন বিশ্রাম নিন। লেখা পাঠানোর প্রয়োজন নেই। তিনি ওয়ার্ক ফর হোম করতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতিদিন তাঁর লেখা চাই। তিনি বলতেন, লিখতে না পারলে আমি ডিপ্রেশনে পড়ব।
মঙ্গলবার রাজাবাজারে তাঁর জানাযায় উপস্থিত হয়েছিলাম। এশার প্রার্থনার পর কাচ্চি মসজিদের পাশেই তাঁর জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হয়। বলতে গেলে স্থানটি তাঁর বাড়ির সামনে। তাঁর জানাযায় শরিক হতে পুবের কলম থেকে অনেকেই গিয়েছিলেন। এর মধ্যে সম্পাদক ও তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে ছিলাম আমি, ছিলেন পুবের কলম-এর জেনারেল ম্যানেজার কাজী আলি আকবর, মুহাম্মদ আলাউদ্দীন মোল্লা, চিফ ফটোগ্রাফার খালিদুর রহিম, সিরাজউদ্দীন খান প্রমুখ। তাঁর জানাযায় শরিক হয়েছিলেন মহল্লাবাসীরা। তাবুত-এ (যাতে চাদর দিয়ে ঢাকা মরদেহকে বহন করা হয়) রাখা তাঁর লাশকে সামনে রেখে জানাযার নামাযের জন্য ইমাম সাহেব তাকবীর ধ্বনি উচ্চারণ করলেন।
কয়েক কাতার মানুষ সারিবদ্ধ হয়ে সদর নঈম সাহেব-এর জন্য প্রার্থনা করলেন। তাঁকে বাগমারি কবরস্থানে সমাহিত করার জন্য তাবুত কাঁধে নিলেন পর্যায়ক্রমে অনেকেই। ছিলেন তাঁর দুই পুত্র। আমিও প্রিয় নঈম ভাইয়ের শেষযাত্রায় কাঁধ দিলাম। এরপর গাড়িতে তাবুত তুলে তা রওনা দিল বাগমারির উদ্দেশে। বাগমারি এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ কবরস্থান। তাঁর পরিবার তাঁকে এখানেই সমাহিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জানাযায় অনেকের মুখে শোনা গেল ‘লা ইলাহা ইল্লাললাহ’। আল্লাহ্ ছাড়া কোনও উপাস্য নেই।
এভাবেই চলে গেলেন বাংলার একজন অগ্রণী বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও লেখক। তাঁর লেখায় কখনোই আপসের ছাপ থাকত না। তিনি ছিলেন প্রথম শ্রেণির একজন সাংবাদিক ও সম্পাদক। কিন্তু কখনোই তাঁর মুসলিম পরিচিতি থেকে শেখ সদর নঈম বিসর্জন দেননি। অনেকেই কিন্তু বাহবা পাওয়ার উদ্দেশে ভোল পালটাবার চেষ্টা করতেন। কিন্তু সদর নঈম সেই পর্যায়ের মানুষ ছিলেন না। অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন হিন্দু-মুসলিম সহযোগিতার ঘোরতর সমর্থক। আমরা আল্লাহর তাঁর জান্নাত কামনা করছি। হে আল্লাহ্ তুমি তাঁকে ক্ষমা করো এবং সর্বোত্তম পুরস্কার দান করো।