আসিফ রেজা আনসারী: বুধবার ছিল ইসলাম ধর্মের শেষ নবী ও রাসুল হযরত মুহাম্মদ সা.-এর জন্মদিন বা মিলাদ-উন-নবী। এ উপলক্ষে শনিবার বিশেষ আলোচনাসভা ও নবীকে কেন্দ্র করে ‘পুবের কলম’-এর বিশেষ সিরাত-উন নবী সংখ্যার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয় পার্ক সার্কাসে অবস্থিত ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস অ্যাসোসিয়েশনের অডিটোরিয়ামে। সেখানে নবী-জীবনের নানান দিক নিয়ে আলোচনা করেন বিশিষ্টরা।
শুধু তাই নয়, ছিল নাতে-রসুল ও ইসলামি সংগীত পরিবেশনাও। এই অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট বক্তাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যসভার সাংসদ ও প্রসার ভারতীর প্রাক্তন সিইও আইএএস জহর সরকার, বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক বিশ্বে নন্দ¨, কলকাতা পুরনিগমের মেয়র পারিষদ আমিরুদ্দিন ববি, সিররি শক্তি অ্যাকাডেমির প্রতিষ্ঠাতা আবদুর রহিম, রাজ্য সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান ও ‘পুবের কলম’-এর সম্পাদক আহমদ হাসান ইমরান, বঙ্গীয় সংখ্যালঘু বুদ্ধিজীবী মঞ্চের সভাপতি ওয়ায়েজুল হক, হজ কমিটির সদস্য সমাজসেবী কুতুবউদ্দিন তরফদার, আমানত ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শাহ আলম, পিএসসির প্রাক্তন চেয়ারম্যান সহিদুল ইসলাম প্রমুখ।
এ দিনের অন্যতম বক্তা জহর সরকার সাম্প্রতিক ভারতের পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বক্তব্য রাখেন। একইসঙ্গে তাঁর আহবান একে-অপরকে জানতে হবে। সমাজে কিছু খারপ লোক আছে, তাদের গুরুত্ব না দিয়ে বেশিরভাগ মানুষ যাঁরা সহাবস্থান ও সম্প্রীতি চান তাঁদের আরও কাছে টানতে হবে। জহর সরকারের মতে, বর্তমানে একটি গোষ্ঠী প্রতিনিয়ত সমাজে বিষ ছড়াচ্ছে। এখন যা হচ্ছে তা ৫০০ বছরেও হয়নি। তিনি নাম না করেই বিজেপি ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আক্রমণ করে বলেন, ব্রিটিশের কাছে ক্ষমা-ভিক্ষা করা বা মুচলেকা দেওয়া যাঁদের ইতিহাস, যাঁরা ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন অংশগ্রহণকারীদের তথ্য ব্রিটিশের সরবরাহ করেছে, যাঁর হাতে গুজরাত দাঙ্গার রক্ত লেগে আছে, তাঁদের কাছে দেশপ্রেম বা জাতীয়তা শিখতে যাব না।
তাঁর অভিযোগ, বিজেপি বর্তমানে মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে দেশের মূল সমস্যা থেকে মানুষের নজর ঘোরাতে চাইছে। এমন মিথ্যাপ্রচার ২০০৯ সাল থেকেই শুরু হয়েছিল বলেই তিনি উল্লেখ করেন। কমনওয়েলথ গেমস নিয়ে মনমোহন সরকারের বিরুদ্ধে প্রচার থেকে শুরু করে অন্না হাজারের ধরনা, নানান বিষয়ে বিজেপির মিথ্যাপ্রচার নিয়ে তিনি সরব হন। জহর সরকার আদানি-আম্বানি থেকে শুরু করে বাজারদর, নানা ইস্যু নিয়েও আলোকপাত করেন। তাঁর কথায়, ২০১৪ সালে আম্বানির সম্পত্তি ছিল ২২ বিলিয়ন ডলার, আজ হয়েছে ১২০ বিলিয়ন ডলার, একইভাবে আদানির সম্পত্তি ১৪ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৪০ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে, গরিব মানুষের ঘরে টাকা নেই। মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়ে মানুষকে উসকে দেওয়ার একটা চেষ্টা হচ্ছে, তবে এটা সফল হবে না বলেই মনে করেন জহর সরকার। অন্য প্রসঙ্গে তিনি ‘ইন্ডিয়া’ জোট নিয়েও আশার কথা শোনান।
আহমদ হাসান ইমরান মিলাদ-উন-নবী উপলক্ষে অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, শেষ নবী মুহাম্মদ সা. ছিলেন মানবতার মুক্তি দূত। তিনিই তৎকালীন সমাজের যাজকপ্রথা ও দাসপ্রথার অবসান ঘটান। সবার জন্য যে একই আইন তা শুধু ঘোষণা নয়, প্রতিষ্ঠাও করেন। এমনকী আল্লাহ্র আইনে নিজের মেয়ে দোষী হলেও যে শাস্তি দিতে তিনি পিছপা হবেন না বলে প্রতিজ্ঞ ছিলেন, এটাই মুহাম্মদ সা.-এর জীবনে দৃঢ়তার উদাহরণ। তাঁর কথায়, বর্তমান সমাজের তরুণ প্রজন্ম নবী সা.-এর জীবনাদর্শ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তাই সু¨র আলোচনা করতে এবং হিন্দু-মুসলিমের মিলিত সমাজকে কীভাবে আরও সমৃদ্ধ করা যায়, এ নিয়ে ভাব-বিনিয়মই আজকের অনুষ্ঠান মূল উদ্দেশ্য।
এ দিনের অন্য বক্তা আবদুর রহিম ইকবালের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, নবীকে ভালোবাসি মুখে উচ্চারণ করলেই হবে না। তাঁর আর্দশ ও বিশ্বাসকে বাস্তবায়ন করতে হবে। তাঁর কথায়, নবী সা.-এর জীবনে উদ্দেশ্যহীনতা ছিল না। তিনি ন্যায়পরায়ণতা ও ক্ষমার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
আর বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক বিশ্বেন্দু নন্দ¨ ভারতে মুসলিম শাসনের সময়ের নানান দিক নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, নবী সা.-এর অনুসারীরা ভারতে শাসনকালে হিন্দু-মুসলিমের মিলিত ও একটি সংশ্লেষী সমাজব্যবস্থা প্রবর্তন করতে সক্ষম হন। মুসলিম শাসনামলকে তিনি ভারত ও বাংলার সমাজ ও অর্থনীতিতে শ্রেষ্টতম যুগ বলে অভিহিত করেন। তবে সমাজে যে বিষ ও ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে এ নিয়ে বিশ্বেন্দুর মত, একটি শ্রেণি পরিকল্পনা করে সমাজে বিষ ছড়িয়েছে। একে-অপরের সঙ্গে মেলামেশা ও সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের পরিবেশকে বাঁচাতে হবে, তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
একইভাবে নবী জীবনের নানান দিক ও তাঁর আদর্শকে মানান উপর জোর দিতে বলেন সমাজসেবী কুতুবউদ্দিন তরফদার। আর ওয়ায়েজুল হক নবী সা.-এর জীবনের বেশ কিছু ঘটনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, নবী সা.-কে ভালোবাসতে হলে তাঁর আদর্শকে মানতে হবে। তিনি সমাজিক ন্যায় ও সম্প্রিীতি প্রতিষ্ঠার কাজ করে গেছেন। বর্তমান সময়ে দিশাহীন সমাজ নবী সা.-এর জীবন থেকে শিক্ষা নিলে অবস্থা পালটাবে।
অবসরপ্রাপ্ত আইএএস ও পিএসসির প্রাক্তন চেয়ারম্যান সহিদুল ইসলাম মুহাম্মদ সা.-এর জীবনের বেশ কিছু ঘটনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সমাজসেবা, পরিবেশ রক্ষা ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠায় নবী মুহাম্মদ সা.-এর শিক্ষা সবার কাছে আদর্শ।
সমাজসেবী শাহ আলমের আহ্বান কুরআন -হাদিসকে বুঝে পড়তে হবে। আমরা ভালো করে এগুলি অধ্যায়ন করলে জীবনে চলার পথ খুঁজে পাব।
অনুষ্ঠানে ইসলামি সংগীত ও নাতে-রসুল পরিবেশ করেন নুপূর কাজী, মীর সামসুল আলম ওরফে পলাশ চৌধুরি, এহতেশামূল হক প্রমুখ। আর সঞ্চালনা করেন মামুন আখতার। সামগ্রিক তত্ত্বাবধান করেন পুবের কলম-এর সম্পাদক ও রাজ্য সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান আহমদ হাসান ইমরান। কলকাতা ও অন্যান্য জেলা থেকে বহু বিশিষ্টজন অনুষ্ঠানে শ্রোতা-দর্শক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন।