হাওড়ার দ্বীনিয়াত মুয়াল্লিমা কলেজ ইতিমধ্যেই অনন্য এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছে। এখানে বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে দ্বাদশ উত্তীর্ণ ছাত্রীরা আসছে এবং ইসলামী ও আধুনিক শিক্ষায় নিজেকে প্রশিক্ষিত করে তুলছে। তারা এরপর শিক্ষিকা হিসেবে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ পাবে। আর তারা মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষার আলো ছড়াতে পারবে ছাত্রীদের মধ্যে। এই কলেজের ছাত্রীদের অনলাইনেও বিভিন্ন ডিগ্রি। কোর্সে ভর্তির সুযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, হাওড়ার দ্বীনিয়াত মুয়াল্লিমা কলেজের শিক্ষা-ব্যবস্থার অনুকরণে আরও প্রতিষ্ঠান এবং স্কুল পড়ুয়া ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য মকতব গড়ে উঠতে আরম্ভ করেছে বাংলার বিভিন্ন জেলায়। এই নিবন্ধে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রমের মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছেন গবেষক ও সমাজবিজ্ঞানী সাবির আহমেদ।
দ্বীনিয়াত মুয়াল্লিমা কলেজ রাজ্যে মুসলমান মেয়েদের জন্য অভিনব এক শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে। মাত্র বছর পাঁচেকের মধ্যে প্রায় পাঁচ শতাধিক ছাত্রী ‘মুয়াল্লিমা’ অর্থাৎ শিক্ষিকা হিসাবে ইতিমধ্যে মিশন, মক্তব ও নানান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত হয়েছেন। কলেজের মূল নীতি হল, জীবনমুখী ও জনমুখী শিক্ষার মাধ্যমে মুসলমান মেয়েদের সার্বিক মানোন্নয়ন ও উচ্চশিক্ষার প্রচেষ্টা। পাঠ্যসূচিতে ইসলামের মূল ভিত্তিগুলো, যেমন কুরআন, হাদিস, আকাইদ ও মাসায়েল, ইসলামি তারবিয়াত এবং আরবি, উর্দু ভাষা শিক্ষা ও পুঙ্খানুপুঙ্খ পাঠদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে, তেমনি কম্পিউটার, নিউট্রেশন, হেলথ, হোম ম্যানেজমেন্ট, চাইল্ড সাইকোলজি এবং টিচিং মেথডোলজি নিয়ে পড়াশোনা করছেন ছাত্রীরা। এই উদ্যোগ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ ছাত্রীদের ড্রপআউট প্রতিরোধ করতে ভীষণ কার্যকরী বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা।
ইসলামিক শিক্ষা ও আধুনিক শিক্ষার মেলবন্ধনে গড়ে ওঠা এই পাঠক্রমের ফলে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর ছাত্রীদের পরিচয় পাওয়া গেল কলেজের নিজস্ব ক্যাম্পাসে ১৫ আগস্ট অনুষ্ঠিত এক মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানে। মেয়েরা একদিকে দ্বীনের প্রতি দায়বদ্ধতা ও দেশের প্রতি কর্তব্যের এক ছকভাঙা ছবি তুলে ধরেন। কলেজের ধারা অনুসারে কলেজের ছাত্রীরা একের পর পর বুদ্ধিদীপ্ত উপস্থাপনা করেন। গোটা অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন ছাত্রীরাই। ইসলামিক শিক্ষায় কীভাবে মেয়েরা মুয়াল্লিমা হচ্ছেন এবং আধুনিক শিক্ষার জীবনমুখী শাখায় তাঁরা কীভাবে শিক্ষালাভের সুযোগ পাচ্ছেন, তা সুন্দর উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে তুলে ধরেন তাঁরা। স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান ছাড়াও এ দিন বার্ষিক সার্টিফিকেট প্রদান অনুষ্ঠানে সফল ছাত্রীদের হাতে সার্টিফিকেট ও পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।
এই অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলেমে দ্বীন তথা অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ডের জেনারেল সেক্রেটারি জনাব হযরত মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ রহমানি সাহেব। তিনি ২০২২ সালের পাশ আউট ছাত্রীদের হাতে সার্টিফিকেট তুলে দেন এবং দ্বীনিয়াত মুয়াল্লিমা কলেজের নতুন বিল্ডিংয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় তলের ভিত্তি ফলক স্থাপন করলেন। হাওড়া জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ আম্বিয়া খাতুন কলেজের এই উদ্যোগ ও নারীশিক্ষায় এর ভূমিকার কথা জোর দিয়ে বলেন। সামাজিক কাজের মধ্যে দিয়ে ছাত্রীদের আত্মবিশ্বাস, নেতৃত্বদানের সক্ষমতা, নিজের মত ও বক্তব্যকে অন্যের সামনে সাবলীলভাবে তুলে ধরতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। কলেজ আয়োজিত ‘পড়ার আনন্দ’ ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গে নামকরা সংবাদমাধ্যমে আলোচিত হয়েছে।
শুরু থেকেই এই কলেজ একটা অস্থায়ী ক্যাম্পাসে চালু হয় চেয়ারম্যান শেখ মাসুদুর রহমান সাহেবের প্রচেষ্টায়। কলেজের জন্য নিজস্ব ভবন পাঁচ বছরের জন্য ছেড়ে এক মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। এবার কলেজের নিজস্ব ভবন হতে চলেছে।
এই কলেজের সম্প্রসারণ নিয়ে পরিকল্পনার কথা কলেজের সম্পাদক সেখ হায়দার জানিয়েছেন, আল্লাহর অশেষ কৃপায় কলেজের নতুন ভবনের স্বপ্ন সফল হতে চলেছে। অনেক মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত আর্থিক সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছে, এখনও অনেক কাজ বাকি। চেয়ারম্যান জানালেন, আমরা আশা করি মুসলমান নারী উন্নয়নে আরও অনেকে এই কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবেন। আমি আশা করি সমাজের সব অংশের ছাত্রী এই কলেজে পড়াশোনা করতে আসবে।
কেন নারীশিক্ষা জরুরি এই প্রসঙ্গে প্রধান অতিথি খালিদ সাইফুল্লাহ রহমানি সাহেব ছাড়াও প্রাক্তন এমপি ও ‘পুবের কলম’ পত্রিকার সম্পাদক জনাব আহমদ হাসান ইমরান সাহেব মন্তব্য করেন, নারীশিক্ষার সঙ্গে ইসলামের এক ঐতিহাসিক যোগ আছে। এই কলেজ সেই ঐতিহ্য বহন করছে। ছাত্রীদের নানান রকমের প্রেজেন্টেশন দেখে তিনি বলেন, মাদ্রাসা ও কলেজ শিক্ষার মেলবন্ধন যে কার্যপ্রক্রিয়ায় অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করছে, তা সত্যিই খুব প্রশংসনীয়। কারণ ইসলামের ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি বিগত কয়েক শতাধী পূর্বে, একই ছাতার তলায় আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ইসলামিক শিক্ষাও প্রদান করা হত। বর্তমান ভারতে যেভাবে মুসলমান মেয়েদের পশ্চাৎপদতার জটিল বন্ধনীতে ফেলা হয়, এই কলেজের কাজ সেসব অতিকথনকে মুছে ফেলবে। এ ছাড়া কলেজের জীবন-জীবিকা মুখী পাঠ্যক্রম সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
এ প্রসঙ্গে উপস্থিত হাওড়া জেলা সংখ্যালঘু উন্নয়ন অফিসার মুদাসসার সাহেব বলেন, এই কলেজ উপযুক্ত পরিবেশ ও সিলেবাসের মাধ্যমে মুসলমান মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণের সুন্দর ব্যবস্থা করেছে। একইসঙ্গে ইসলামিক শিক্ষা ও আধুনিক শিক্ষার মেলবন্ধনে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের থেকে ভিন্ন। এই কলেজের উন্নয়নে আমার ২০০ শতাংশ সহযোগিতা সর্বদা আপনাদের সঙ্গে থাকবে। তিনি পরামর্শ দিয়েছেন কলেজের পাঠ্যসূচিতে বিপর্যয় মোকাবিলা কোর্স অন্তর্ভুক্তি করলে সরকার যথাযথ সাহায্য করবে।
অনুষ্ঠানে হাজির সমাজের গণ্যমান্য উলামা ও প্রশাসনিক উচ্চপদের মানুষজন এক বাক্যে স্বীকার করেছেন দ্বীনিয়াত মুয়াল্লিমা কলেজের এই অনুষ্ঠানে হাজির না হলে মুসলমান মেয়েরা এতটা এগিয়ে যেতে পারে, তা জানার সুযোগ হত না। এই সাফল্য কীভাবে এসেছে। এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল ‘ডিপ্লোমা ইন দ্বীনিয়াত এডুকেশন’-এ এবারের প্রথম হয়েছেন মাসুমা খাতুন। মাসুমার কথায়, এই সাফল্যের পিছনে পরিবারের সঙ্গে দ্বীনিয়াত মুয়াল্লিমা কলেজের অবদান সবচেয়ে বেশি। পড়াশোনার পরিবেশের সঙ্গে নানা আধুনিক শিক্ষা লাভের ফলে নিজেকে আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে। সফল ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যে শিক্ষা এখান থেকে পেয়েছেন, তার প্রচার ও প্রসারের কাজ করবে। উপস্থিত ছিলেন হযরত মাওলানা ক্বারী ফজলুর রহমান সাহেব। তিনি কলেজের সিলেবাস, পঠন-পাঠন এবং পড়াশোনার মানোন্নয়ন দেখে আনন্দিত হয়ে বলেন, মেয়েদের দ্বীনি পড়াশোনার মান ও পরিবেশের উন্নয়ন ঘটুক।
খালিদ সাইফুল্লাহ রহমানি সাহেব আশা করেন, ‘ভারতের তথা বাংলার প্রতিটি কোনায় কোনায় এই ধরনের কলেজ ছড়িয়ে পড়ুক। বাংলার প্রত্যেক জেলা থেকে, আর্থ-সামাজিক ও মেধাসম্পন্ন ছাত্রীরা এই কলেজের শিক্ষা গ্রহণ করে মহিলা ক্ষমতায়ন এবং মুসলিম সমাজের মানোন্নয়ন ঘটাবে ইনশাআল্লাহ্। নারীশিক্ষার মানোন্নয়নে এক নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটাবে এই দ্বীনিয়াত মুয়াল্লিমা কলেজ।
লেখক: প্রতীচী ট্রাস্টের ন্যাশনাল রিসার্চ কোঅর্ডিনেটর।