আহমদ হাসান ইমরান/আবদুল ওদুদ: হজ প্রত্যেক সক্ষম মুসলিমের জন্য অবশ্য পালনীয় এক পবিত্র ইবাদত। আজ কম করে হাজার বছর ধরে ভারত থেকে হাজী-রা মক্কা ও মদীনায় যাচ্ছেন। কিন্তু এ বছর জাতীয় সংখ্যালঘু মন্ত্রক এবং তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন কেন্দ্রীয় হজ কমিটি যে ব্যবস্থাপনা করেছে, তাতে চরম দুর্ভোগ ও দুর্দশার মধ্যে পড়তে হচ্ছে হজযাত্রীদের। যখন পানি জাহাজে করে হজে যাওয়া হত তখনও কিন্তু পুরুষ ও মহিলা হজযাত্রীদের এত শোচনীয় দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হয়নি। অথচ কেন্দ্রের বিজেপি সরকার হজের ভর্তুকি তুলে দিয়েছে এবং হজের মোট খরচ এবং বিমান ভাড়া বৃদ্ধি করেছে ব্যাপকভাবে।
কেন্দ্রীয় সরকারের এই ধরণের অব্যবস্থাপূর্ণ হজ-নীতির কারণে হাজার হাজার পুরুষ ও মহিলা হজযাত্রীকে এক বিপর্যয়ী অবস্থার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। সব থেকে বড় কথা, এমন কেউ নেই যে তীর্থযাত্রীদের এই দুর্ভোগ কবে কিভাবে দূর হবে তার কোনও স্পষ্টিকরণ দেবেন! শুধু হজযাত্রীদের কোনওভাবে নবী সা.-এর শহর মদীনায় পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে (বিমানে মক্কায় পাঠানো এখনও শুরু হয়নি।
(৬ জুন, ২০২৩ ভারতীয় হজযাত্রীজের মক্কায় পাঠানো শুরু হবে)। ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু মন্ত্রক ২০২৩-এর হজ-নীতি নির্ধারণ করেছে। তাতে হজযাত্রীদের সুবিধা নিয়ে কোনও উল্লেখই করা হয়নি। শুধু বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর যে হজ কোটা ছিল, তা তুলে দেওয়া হয়েছে।
প্রথমে বলা যাক, পূর্ব ভারতের প্রধান আরোহণ পয়েন্ট কলকাতায় কি ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। প্রথম ভোগান্তি হল, জাতীয় সংখ্যালঘু মন্ত্রক ও কেন্দ্রীয় হজ কমিটি হজযাত্রীদের বহনের জন্য যে বিমান ভাড়া করেছে, তা হচ্ছে সউদি এয়ারলাইন্সের অনুমোদনপ্রাপ্ত বিমান সংস্থা ‘ফ্লাই-এ-ডিল’। এই বিমান সংস্থাটির তেমন কোনও সুনাম নেই। পরিকাঠামো সম্পর্কেও সংশয় রয়েছে। আগে বিমানের টেন্ডারের সময় অভিযোগ উঠত, টেন্ডার দেওয়া নিয়ে নানা অনিয়ম হয়ে থাকে। গ্লোবাল টেন্ডার ডাকা হয় না।
যাই হোক, এই বিমান সংস্থার কারণেও কলকাতা থেকে হজযাত্রীদের গমনের ক্ষেত্রে প্রবল সমস্যা ও হয়রানির সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিটি বিমানে যাত্রী ধারনের ক্ষমতা আগে থেকে স্পষ্ট করে বলা হচ্ছে না। যেমন বলা হচ্ছে, বিমানে হজযাত্রী যেতে পারবে ৩২৬ জন। অথচ বিমান আসার পর বলা হচ্ছে, এই বিমানে যাত্রী ধারনের ক্ষমতা হচ্ছে ২৯৫ জন।
কিন্তু হজযাত্রীদের ৩২৬ জন ধরে ডেকে নেওয়া হয়েছে। শেষ সময় বাদ যাচ্ছেন ৩১ জন। এদের থাকা, খাওয়া এবং পরবর্ত বিমানে আসন বরাদ্দ করা নিয়ে চরম সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য হজ কমিটিকে। হজযাত্রীদের বিদায় দেওয়ার জন্য আসা আত্মীয়-স্বজনের কথা না হয় বাদই দেওয়া গেল।
আর একটি শোচনীয় সমস্যা হল, হঠাৎ হঠাৎই বিমান সংস্থাটি তাদের ফ্লাইট বাতিল বলে ঘোষণা করছে। ফলে প্রায় ৩২৬ বা ২৯৫ জন হজযাত্রী এয়ারপোর্টে ফ্লাইট ধরার জন্য অপেক্ষা করছিলেন তাঁরা অকূল পাথারে পড়ছেন। কোথায় থাকবেন, কবে আবার ফ্লাইট পাবেন এসব সমস্যা নিয়ে চরম হয়রানি।
আর একটি বড় অসুবিধা হচ্ছে, সউদি আরব থেকে হজযাত্রীদের ভিসা আসতে খুবই বিলম্ব হচ্ছে। ফলে হজযাত্রীদের ডেকেও তাঁদের বিমানে আসন দিতে পারছেন না রাজ্য হজ কমিটি। এই অসুবিধা দূর করতে পারে হজের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় এবং বিদেশ মন্ত্রণালয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত এই দুই মন্ত্রণালয় কিন্তু ভিসা বিলম্বের জন্য সউদি সরকারের সঙ্গে কথা বলেছে বলে কোনও খবর পাওয়া যায়নি।
কলকাতা থেকে যাওয়া হজযাত্রীদের সঙ্গে সবথেকে হৃদয়বিদারক যে অসুবিধা ঘটছে তাহল, কোনওক্রমে তো মদীনা শরীফে পৌঁছানো হল। এয়ারপোর্ট থেকে বাস হজযাত্রীদের নিয়ে এসে হোটেল এলাকাতে নামিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু নির্দিষ্ট হোটেলগুলি হজযাত্রীদের স্থান দিচ্ছে না।
ফলে নারী, বুজুর্গ, প্রতিবন্ধি সব হজযাত্রীদের রাস্তার উপর বসে থাকতে হচ্ছে। আর রয়েছে সউদি আরবের সেই প্রচন্ড তাপপ্রবাহ। রাস্তায় অসহায় হয়ে বসে থাকা এই হজযাত্রীদের খাওয়া কিংবা টয়লেটের কোনও ব্যবস্থাই নেই। ৮-৯ ঘণ্টা রাস্তায় থাকার পর যদিও বা হোটেলে রুম পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে, তাদের বলা হচ্ছে তোমরা আরও চারজন সঙ্গী জোগাড় কর। রুমে চারজন নয় আটজন করে রাখা হবে। অথচ ঠিক ছিল এক রুমে চারজন হজযাত্রী থাকবেন।
মদীনাতে ভুক্তভোগী কয়েকজন হজযাত্রীদের সঙ্গে পুবের কলম যোগাযোগ করে কথা বলে। তাঁদের মর্মান্তিক এবং অশ্রুভরা বৃন্তান্ত যে কোনও হৃদয়কে বিগলিত করবে। হজ মন্ত্রকের কথা অবশ্য ভিন্ন। তাদের এই অনীহা ও অবস্থার কারণে হজযাত্রীদের এই শোচনীয় অবস্থা। এই হজযাত্রীরা বলেন, আমরা হজ করতে এসেছি প্রায় চার লক্ষ টাকা খরচ করে। ভেবেছি মদীনাতে এসে ইবাদত করব। কিন্তু কোথায় কি! খোলা রাস্তায় পড়ে রয়েছি। আমাদের গাইড করারও কেউ নেই। কোথাও কোনও খাদিমুল হুজ্জাজের সন্ধান পাচ্ছি না। আমাদের দূতাবাসেরও কারও খোঁজখবর মিলছে না।
পুবের কলম থেকে অনুসন্ধান করে জানা গেল, পশ্চিমবঙ্গ থেকে ২৮ জন খাদিমুল হুজ্জাজের যাওয়ার কথা। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কেন্দ্র অনুমতি দিয়েছে মাত্র ১৯ জনকে পাঠাতে। এখন পর্যন্ত তড়িঘড়ি করে মাত্র ৬ জন খাদিমুল হুজ্জাজকে মদীনা পাঠানো সম্ভব হয়েছে।
কেন এই বিলম্ব? কেন এই অনীহা? কেন হজযাত্রীদের এই হয়রানি? তার উত্তর হয়তে একদিন হজমন্ত্রী স্মৃতি ইরানি দিতে পারেন। কিন্তু তাতে হজযাত্রীদের কোনও শোচনীয় অবস্থার পরিবর্তন হবে না। ভারতীয় হজযাত্রীদের এই দুর্ভোগ কি বিজেপি আমলে চলতেই থাকবে?