পুবের কলম ওয়েবডেস্কঃ উপমহাদেশীয় ক্রিকেটে দুই মহাতারকাকে নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। বিরাট কোহলি ও বাবর আজমের। গতবছরেই বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার বিরাট কোহলিকে পিছনে ফেলে দিয়ে আইসিসির ওয়ানডে ও টি-২০ র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে উঠে এসেছেন পাকিস্তান অধিনায়ক বাবর। যদিও অনেকেই মনে করেন বিরাট কোহলির সঙ্গে এখনই বাবর আজমের তুলনা অর্থহীন। কারণ বিরাট ওয়ানডে ক্রিকেটে ইতিমধ্যেই ৪৪টি এবং টেস্টে ২৭টি সেঞ্চুরি করে ফেলেছেন। সেখানে বাবরের ওয়ানডে ১৭টি ও টেস্ট সেঞ্চুরির সংখ্যা ৭টি। কিন্তু যেভাবে মাত্র কয়েকটা বছরে বাবর আজম নিজেকে একটা আলাদা উচ্চতায় নিয়ে চলে গিয়েছেন, তা এক কথায় অনবদ্য। যার জেরেই বিশ্ব ক্রিকেটে এখন বিরাট কোহলির সঙ্গেই উচ্চারিত হচ্ছে বাবর আজমের নাম।
১৯৯৪ সালে লাহোরের একটি পাঞ্জাবি মুসলিম পরিবারে জন্ম হয় বাবরের। প্রাচীর নামক শহরে বাবরের বেড়ে ওঠা ও ক্রিকেটে হাতেখড়ি। তাঁরই চাচাতো ভাই কামরান আকমল এবং উমর আকমল। মূলত তাঁদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে একটা সময় বাবর ক্রিকেটের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তাঁদের জীবনের গল্প এবং সাফল্য বাবরকে একজন সফল ক্রিকেটার হতে সাহায্য করেছিল। এরপর লাহোরে একটি ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে যোগ দেওয়ার মাধ্যমেই শুরু ক্রিকেটে পথচলা। প্রাথমিকভাবে ঘরোয়া ক্রিকেটের মাধ্যমে কেরিয়ার শুরু করার আগেই গদ্দাফি স্টেডিয়ামে বল বয়ের কাজ করেছিলেন। কোচ রানা সাদিকের কাছ থেকে ক্রিকেটের প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। পরবর্তীতে বাবর পাকিস্তানের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে ধারাবাহিকভাবে নজরকাড়া ক্রিকেট খেলে জাতীয় দলের অন্যতম ভরসা হয়ে উঠলেন।
এই মুহূর্তে সব ধরনের ক্রিকেটে একটা এখন নির্ভরযোগ্য নাম হয়ে উঠেছেন বাবর। বিশ্বের অন্যতম সু¨র ব্যাটসম্যান হিসেবেও দেখা হয় বাবরকে। টেস্ট, ওয়ানডে কিংবা টি-২০ ক্রিকেটে বাবর এই মুহূর্তে গোটা বিশ্বের কাছে সমীহ আদায় করে নিয়েছেন। তিনিই একমাত্র ক্রিকেটার, যিনি আইসিসির সব ধরনের ক্রিকেট র্যাঙ্কিংয়ে প্রথম পাঁচের মধ্যে রয়েছেন। ওয়ানডে ক্রিকেটে পরপর তিন ম্যাচে সেঞ্চুরির রেকর্ড, প্রথম কোনও অধিনায়ক হিসেবে ওয়ানডে সিরিজে তিন ম্যাচে ৩৫০-র বেশি রান রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। ইমরান খানের পর পাকিস্তান ক্রিকেটকে খাদের কিনারা থেকে তুলে আনা দ্বিতীয় সফল অধিনায়ক হিসেবেও ইতিমধ্যেই নজির গড়েছেন। ৫ ফুট ১১ ইঞ্চির এই মানুষটি নেতৃত্বের গুণে পাকিস্তানে ক্রিকেটে একটা ভারসাম্য এসেছে। তাঁর অসাধারণ নেতৃত্বে পাকিস্তান বিশ্বের সেরা শক্তিধর দলগুলির বিরুদ্ধে জিততে শুরু করেছে। তিনিই প্রথম পাকিস্তান ক্যাপ্টেন, যাঁর নেতৃত্বে পাকিস্তান প্রথমবার বিশ্বকাপের মঞ্চে ভারতকে ১০ উইকেটে হারাতে সমর্থ হয়েছে।
বাবর আজমের অধিনায়কত্বে কয়েকদিন আগে অস্ট্রেলিয়াকে ওয়ানডে সিরিজে ২-১ ব্যবধানে হারিয়েছে পাকিস্তান। তাঁর নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে গিয়ে টি-২০ সিরিজ জিতে ফিরেছে পাকিস্তান। সেই সফরে টেস্ট সিরিজেও সমতা বজায় রেখে ফিরেছিল পাকিস্তান। তিনিই যেন পাক ক্রিকেটকে নতুন দিশা দেখিয়ে চলেছেন। শেষ কয়েক দশকে পাকিস্তানের ক্রিকেট সাম্রাজ্য অবশ্য এতটা শক্তিশালী ছিল না। বাবর আজম অধিনায়কত্বে পাক ক্রিকেটে বদল এসেছে। নিজে রান করছেন, বাকি ক্রিকেটারদের রান করতেও উদ্বুব্ধ করছেন। বাবর যেভাবে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, একইভাবে পাকিস্তান ক্রিকেটকে যেন নতুন করে প্রতিষ্ঠা দিলেন বাবর আজম।
২০১৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে বাবর আজমের টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই সেই বাবর হয়ে গেলেন পাকিস্তানের টেস্ট অধিনায়ক। তার ঠিক এক বছর আগে ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল তাঁর। খুব কম সময়ের মধ্যে পাকিস্তানের ওয়ানডে দলের ব্যাটনটাও এলো বাবরের হাতে। ঘরোয়া ক্রিকেটে ২০১০-১১ মরশুমে জারাই তারাকিয়াতি ব্যাঙ্কের দলে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরপর ইসলামাবাদ লেপার্ডস, স্টেট ব্যাঙ্ক অব পাকিস্তান, সাউদার্ন গ্যাস কর্পোরেশন, ইসলামাবাদ ইউনাইটেড হয়ে করাচি কিংস, গায়ানা অ্যামাজন ওয়ারিয়র্স, সিলেট সিক্সার্সের হয়ে খেলেছেন। কাউন্টিতেও সামারসেটের হয়েও সফলভাবে খেলেছেন বাবর।
গদ্দাফি স্টেডিয়ামের এক সময়ের বল বয় বাবর আজ শুধু পাক ক্রিকেটের নয়, বিশ্ব ক্রিকেটের পোস্টার বয় হয়ে উঠেছেন। তাঁর প্রথম কোচ রানা সাদিক ঠিক যেভাবে তাঁকে ক্রিকেটীয় পাঠ দিয়েছিলেন, তার অক্ষরে অক্ষরে পালন করে বাবর আজ পাক ক্রিকেটের একচ্ছত্র অধিপতি ‘সম্রাট বাবর’-এ পরিণত হয়েছেন। ২০১৮-র বিশ্বকাপের ব্যর্থতার পর সরফরাজ আহমেদকে সরিয়ে যখন পাক ক্রিকেটের ব্যাটন বাবরের হাতে তুলে দেওয়া হল, তখন যেন পাকিস্তান ক্রিকেট কোমায় আছন্ন। তরুণ বাবর দায়িত্ব নিয়ে মাত্র সাড়ে তিনটে বছরেই কোমায় থাকা পাকিস্তান ক্রিকেটকে দিয়েছে নতুন প্রাণ। আজ তাঁর কাঁধে চেপেই পাক ক্রিকেট যেন পৌঁছে গিয়েছে পাহাড় চূড়ায়।