উজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায়,সুন্দরবন : এবছর কোন ও রকম পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই ওরা চলে এল অতিথি হয়ে। সুন্দরবনে বিদেশী পরিযায়ী পাখিদের ভিড় দেখতে পাওয়া গেল।শীত বাড়তেই সুন্দরবনে পরিযায়ী পাখিরা ভিড় জমাতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক নতুন করে গড়েওঠা কৃত্রিম ম্যানগ্রোভ জঙ্গলে এদেরকে বেশি দেখা যাচ্ছে।
সীমানা এবং এলাকা দখল নিয়ে ভারতের সঙ্গে চিন বা পাকিস্তানের সম্পর্ক মধুর নয়, কিন্তু ওইসব দেশের পাখিদের সঙ্গে আমাদের আত্মীয়তায় আজ ও কোনও ছেদ পড়েনি। ওই দুই নিষিদ্ধ দেশের সঙ্গে পাখিদের অবাধ আনাগোনা চলছে।
পাখিদের সংখ্যায় ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।কোনও রকম পাসপোর্ট, ভিসা ছাড়াই রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ফিনল্যান্ড, ইরান দেশ থেকে হাজার হাজার পাখি সমুদ্র পথ ধরে দলে দলে চলে আসছে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যে। ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন জায়গায়।
এই পাখিদের মধ্যে বেশিরভাগই সামুদ্রিক এলাকার জলচর, দিবাচর এবং নিশাচর।সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ জঙ্গলে পাখিদের খাওয়ার কোনও উপযুক্ত কোন ফলের গাছ নেই তবুও বিশেষ কোনও আকর্ষণে পাখিরা হাজার হাজার মাইল আকাশপথে বিরাম হীন ভাবে উড়ে আসছে এই বাঘ-অরণ্যে।এখানে আসা এবং ফেরার পথে দুর্যোগ-দুর্ঘটনায় পড়ে বহু পাখির মৃত্যুও ঘটছে তবুই তাঁরা প্রতি বছর সঠিক সময়ে নির্দিষ্ট জায়গায় চলে আসছে।
এই বিদেশী অতিথিদের যেন কেউ উত্যক্ত বা শিকার না-করে সেই কারণে দক্ষিণ ২৪ পরগনা বন বিভাগ বিভিন্ন অস্থায়ী ‘অতিথি নিবাসে’র আশপাশে প্রহরা বসিয়েছে।এই বিভাগের ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার মিলনকান্তি মন্ডল বলেন, ‘আমরা কয়েক বছর ধরে ম্যানগ্রোভ রোপণ নতুন করে কৃত্রিম বন সৃষ্টি করেছি। সেইসব জায়গায় প্রচুর খাবার পাওয়া যাচ্ছে।আর সেই খারারের টানে পরিযায়ী পাখিরা ভিড় জমাচ্ছে। তাদের নিরাপত্তার জন্যে প্রাহারা বসিয়েছি।’
বন বিভাগের আরও একটি দপ্তর ‘সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্প’ পাখি প্রেমীদের পাখি চেনানোর জন্যে ৭ থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি ‘পাখি উৎসব’-এর আয়োজন করেছে।পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে, বিভিন্ন দেশের প্রায় ৪০ টি প্রজাতির বিদেশী পরিযায়ী পাখি এই শীতের মরশুমে সুন্দরবনে আসে। এই সময় শীতপ্রধান দেশ গুলিতে শীতের মাত্রা বেড়ে যায় অনেকটা।
ওই শীত সহ্য করতে না-পেরে তারা কম শীতপ্রধান সুন্দরবনে ও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় চলে আসে।কিছুদিন সময় কাটানোর পরে আবার নির্দিষ্ট সময়ে নিজেদের দেশে চলে যায়। বংশ বিস্তারের পর পরের বছর আবার সপরিবারে চলে আসে।প্রকৃতি সংসদ নামে কলকাতার একটি পক্ষী পর্যবেক্ষক সংস্থা গত বছর সুন্দরবনে সমীক্ষা চালিয়ে জানতে পেরেছে, রাশিয়ার সাইবেরিয়া থেকে এসেছিল কারলিউ (বড় গুলিন্দা), ফিনল্যান্ড থেকে (হুইমব্রেল) ছোট গুলিন্দা, চিন, তুর্কিস্তান থেকে স্নাইপ (কাদাখোচা),তিব্বত থেকে মিঠুয়া (প্লোভার) পাখিরা।
এছাড়াও চখাচখি (রুড্ডি শেলডাক), ছোটদিঘর (গাডওয়াল), বামুনিয়া (টাফটেড ডাক) বিলিতি জিরিয়া (কেন্টিস) পাখিদেরও দেখা মিলেছিল। এবারও এরা এসেছে কি না এবং নতুন কোনও প্রজাতির পাখিরা আনাগোনা শুরু হয়েছে কি না তা জানতে এই পাখি-প্রেমী সংস্থাটি ১৪ জানুয়ারি থেকে সমীক্ষা শুরু করেছে। পনেরো দিন ধরে চলবে বলে সংস্থাটি সূত্রে জানানো হয়েছে।সুন্দরবন বন বিভাগ সূএে জানা গেল , এবার জম্বুদীপ, কলস, ঠাকুরাণ, মেছুয়া, ছাইমারি চরে সন্ধ্যার পর হাজার হাজার বিদেশী পরিযায়ী পাখি আস্তানা গেড়েছে। ভগবতপুর, বকখালি, গঙ্গাসাগরের রামকর চর এবং মাতলার চরে ভিন রাজ্যের পরিযায়ী পাখিদের গাদাগাদি। বিকেলের পরে চরে কিচিরমিচিতে মন ভরে যায়। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে লোথিয়াদ্বীপ চরে পক্ষীপ্রেমী ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার মিলনকান্তি মন্ডলের ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল ধূসর-পা বাটান (নর্ডম্যানের গ্রীনশ্যাঙ্ক) পাখির ছবি।
বুধবার মিলনবাবু বলেন, এই পাখি গুলি দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, কম্বোডিয়া, মালেশিয়া দেশের পাখি। এই পাখি সুন্দরবনে সর্বপ্রথম এবং ভারতে দ্বিতীয়বার দেখা মিলল।শুধু শীতই নয়, গ্রীষ্ম মরশুমেও আফ্রিকা থেকে হলুদ খঞ্জন (ইয়লো ওয়াগটেল), ইউরোপ থেকে নীলগলা ফিদ্দা (ব্লুথ্রোটেড), উত্তর আমেরিকা থেকে খুন্তেহাঁস (নর্দান স্লোভেলার)-রা আসে।পক্ষী বিশারদরা পাখিদের পরিযান বৈচিত্র্যের একটি আশ্চর্যের ঘটনা উল্লেখ করে জানিয়েছেন, পাখিরা সাধারণত দু’হাজার ফুট উচ্চতা দিয়ে সপ্তাহ থেকে ৪ মাস পর্যন্ত উড়ে আসে। সারাদিন-সারারাত অবিরাম ওড়ে। ওড়ার সময় কোথাও থামে না, কিছুই খায় না। যাত্রা শুরুর আগে ভাল করে খেয়ে নেয়। ঘন্টায় ৫০ মাইল গতিবেগে প্রতিদিন ১৫-৬০০ মাইল পথ উড়ে চলে। নির্দিষ্ট যায়গায় পৌছতে উপকূলরেখা, নদীপথ, সূর্য-চন্দ্র-গ্রহ-তারা-নিক্ষত্রকে লক্ষ্য করে চলে। আর এই পাখি সুন্দরবনে আসায় সুন্দরবনের গুরুত্ব অনেক খানি বেড়ে গেল বলে মনে করে সুন্দরবন প্রেমী মানুষজন।