আবদুল ওদুদ: মাস কয়েক পরেই দেশের লোকসভা নির্বাচন। তার আগে দলীয় কর্মীদের চাঙ্গা করতে বিশেষ অধিবেশনের ডাক দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার কলকাতা নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে রাজ্যের প্রতিটি জেলা থেকে মন্ত্রী,সাংসদ, বিধায়ক ,জেলা সভাপতি ,জেলা পরিষদের সদস্য ব্লক সভাপতি, অঞ্চল সভাপতি , পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি কাউন্সিলর এবং পৌরসভার চেয়ারম্যানদের নিয়ে এই বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।
বক্তব্য রাখতে উঠে প্রথম থেকেই কেন্দ্রে বিজেপি সরকার এবং রাজ্যের বামেদের চাঁচাছোলা ভাষায় আক্রমণ করেন । কেন্দ্রীয় সরকার দেশজুড়ে যে গৈরিকীকরণের করানোর চেষ্টা করছে তার বিরুদ্ধে সুর ছড়ালেন। সর্বত্র গেরুয়া রং করা নিয়ে আগেও বহুবার আপত্তি জানিয়েছেন তৃণমূল সুপ্রিমো। এবার আক্রমণের সুর আরও চড়িয়ে বললেন, ‘রাজ্যের প্রকল্পগুলোয় গেরুয়া রং না করলে টাকা দেবে না বলছে। কী সাহস এদের।’
কলকাতায় তৈরি নতুন মেট্রো প্রকল্পের চারপাশ গেরুয়ায় মুড়ে দেওয়া হয়েছে। এই তথ্য তুলে ধরে কেন্দ্রের গৈরিকীকরণ নিয়ে সুর চড়ালেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বললেন, ‘বলছে প্রকল্পগুলির রং গেরুয়া না করলে টাকা দেবে না। কত বড় সাহস! আমি বলি, তোমাদের টাকা চাই না। সব গেরুয়া করে দেবে বলছে! মেট্রো গেরুয়া, জার্সি গেরুয়া, বাথরুমও এবার গেরুয়া করে দেবে।’ এ প্রসঙ্গে মমতা তুললেন ১০০ দিনের কাজে কেন্দ্রীয় ‘বঞ্চনা’ র কথা। আইসিডিএস অর্থাৎ অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের টাকার ৯০ শতাংশ দেয় কেন্দ্র, ১০ শতাংশ দেওয়ার কথা রাজ্যের। কিন্তু সেই টাকা আটকে কেন্দ্রের ‘গেরুয়া’ পন্থা নিয়ে একপ্রস্ত আক্রমণ শানালেন তৃণমূল নেত্রী।
দেশের ক্রিকেট দলের প্র্যাকটিস জার্সির গেরুয়া রং নিয়ে আগেই কটাক্ষ শোনা গিয়েছিল তৃণমূল সুপ্রিমোর গলায়। নীল-সাদা বাদ দিয়ে অনুশীলনে গেরুয়া রঙের জার্সি নিয়ে তাঁর অভিযোগ ছিল, সর্বত্র গৈরিকীকরণের পথে আরও দ্রুত হাঁটছে কেন্দ্র। আর বৃহস্পতিবার নেতাজি ইন্ডোরের সভায় গৈরিকীকরণ নিয়ে তাঁর সাফ বক্তব্য, ‘গেরুয়া রং তোমাদের জন্য নয়। ওটা ত্যাগীদের জন্য। তোমরা তো সব ভোগী।’
শিক্ষক নিয়োগ থেকে রেশন কিংবা গরু পাচার মামলায় সিবিআই-ইডির স্ক্যানারে রাজ্যের একাধিক নেতা-মন্ত্রী। এই পরিস্থিতিতে জেলবন্দি অনুব্রত, পার্থ, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের পাশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁরা চুরি করতে পারেন না বলেই আত্মবিশ্বাসের সুর তৃণমূল সুপ্রিমোর গলায়। নেতা-মন্ত্রীদের গ্রেপ্তারির পালটা প্রত্যাঘাতের হুঁশিয়ারিও দেন মমতা।
নেতাজি ইন্ডোরের সমাবেশের মঞ্চ থেকেও গরু পাচারের দায় সম্পূর্ণ কেন্দ্রের বলেই দাবি করেন মমতা। তিনি বলেন, ‘গরু কাদের আন্ডারে? বিএসএফ। কাদের অর্গানাইজেশন? কেন্দ্র। গরু পাহারা দেয় কারা? সীমান্ত পাহারা দেয় কারা? বিএসএফ। গরু আসে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান থেকে। ’ মমতা প্রশ্ন ছুড়ে বলেন,‘গাড়ি পাসের সময় তোমরা টাকা খাও না? ল্যাভেঞ্চুস খাও।’
কেন্দ্রকে আক্রমণ করে মমতা আরও বলেন, ‘কয়লা ধুলেও যাবে না ময়লা। এগুলো কার অধীনে? কেন্দ্র।’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘মিথ্যা বারবার বলে সত্যি করা হয়। আমরা সবাই চোর? দুর্নীতি দেখাচ্ছে। আর সেখানে শিখিয়ে টাকা দিয়ে বলা হচ্ছে, বলো তৃণমূল চোর। না বললেই রেড করবে।’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুভেন্দু অধিকারী কে লক্ষ্য করে নাম না করে বলেন গদ্দার বলছে ওর বাড়িতে যাবে। তারপরের দিন সেই বাড়িতেই চলে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। চমকে ধমকে মিডিয়াকে সঙ্গে নিয়ে ইডি সিবিআই কে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এই সরকার যত তাড়াতাড়ি যাবে তত তাড়াতাড়ি দেশের এবং জনগণের ততই মঙ্গল।
তৃণমূল কংগ্রেসের গ্রেফতাঁর হওয়া চার নেতা-মন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে মমতা বলেন, ‘আজ কেষ্ট জেলে, পার্থ জেলে, মানিক জেলে, বালু জেলে। আর হাসছেন। ভাবছেন এটাই চলবে? আগামী দিন যখন চেয়ারে থাকবেন না, তখন কোথায় থাকবেন? জেলে না সেলে? আজ সিপিএম ও বিজেপি কোলবালিশ হয়ে ঘুরছে। এদের একজন বলছে অমুকের বাড়ি যাবে। চলে গেল। লুট করে এল। সিজার লিস্ট দিল না। আন্ডার গান চমকে ধমকে রেখে দিল। এই সরকার যত তাড়াতাড়ি যায় তত ভালো।’ প্রত্যাঘাতের হুঁশিয়ারি দিয়ে মমতা আরও বলেন, ‘আমাদের চার বিধায়ক গ্রেপ্তার হয়েছেন। ওরা যদি চারজনকে জেলে রাখে, আমি পুরনো কেস রিওপেন করে ৮ জনকে জেলে ভরে দেব।’
নাম না করে রাজ্যপালকে কটাক্ষ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘একটা বিল পাশ করতে দেয় না। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মানে না। আমি নিজে গিয়ে কথা বলেছিলাম। তারপরেও সব আটকে। রাজ্য সরকারের টাকায় খাবেন, পুরস্কার দেবেন আর কালারফুল লাইফ কাটাবেন। আর বিল পাশ করতে দেবে না। যেন সব হিটলার একটা।
একশো দিনের কাজের টাকা থেকে একাধিক কেন্দ্রীয় বরাদ্দ না পাওয়ার অভিযোগ তুলে মমতা বললেন, ‘আবার দিল্লি যেতে হবে। ’এর আগেও একাধিকবার দিল্লির থেকে রাজ্যের বকেয়া বরাদ্দ নিয়ে সরব হয়েছে তৃণমূল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বারংবার এই কথা বলেছেন। নেতাজি ইন্ডোর থেকেও সেই কথাও বললেন তিনি।
এ দিন কর্মিসভা থেকে তিনি বলেন, ‘দিল্লিতে আবার ডিসেম্বর মাসে যেতে হবে।’ অর্থাৎ ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ফের দিল্লি অভিযানের ডাক দিলেন তিনি। তিনি একথাও বললেন, ‘সংসদ চলাকালীন যাব। সব সাংসদ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সময় চাইব। যদি সময় না দেন তাহলে রাস্তায় আবার পথ দেখাবে।’
রাজ্যের প্রাক্তন শাসকদল সিপিএম-কে বেনজির আক্রমণ করতে দেখা গেল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বললেন, ‘সিপিএমের কান মুলে দেওয়া উচিত। রাজনৈতিক ভাবে। ওদের সময়ে কী কাজ হয়েছে? ওরা শুধু মিথ্যা কথা বলে।’এদিন মমতার মুখে উঠে আসে জয়নগরের তৃণমূলনেতা খুনের ঘটনা প্রসঙ্গও। তৃণমূলনেত্রী বলেন, ‘জয়নগরে পরপর তিন-চারটে খুন করেছে। তাঁদের মুখে আবার বড় বড় কথা। সিপিএম নরকঙ্কাল নিয়ে খেলা করত। শূন্যে চলে গেছে। ওই শূন্যতেই পড়ে থাকবে।’
এদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষনা দেন আগামি ২ ও ৩ ডিসেম্বর জেলায় জেলায় প্রতিটি বুথে ১০০ দিনের টাকা নিয়ে কেন্দ্রের বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশ করতে হবে। নতুনরা পুরাতনদের সন্মান দিবেন। ছাত্র, যুব ,মহিলা,মতুয়া সংখ্যলঘু সকলে কাধে কাধ মিলিয়ে কাজ করবে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন ‘ওরা নোটের বান্ডিল নিয়ে ঘুরছে অপনারা খড়ের বান্ডিল নিয়ে ঘুরুন।’ এদিন দলনেত্রী বঙ্গজননী ও মহিলা তৃণমুল কংগ্রেসকে এক করে মালা রায় ও চন্দ্রিমার হাতে দায়িত্ব দেন।