আহমদ হাসান ইমরান: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যখন তেল আবিবে তাঁর বিশাল বিমানে অবতরণ করলেন, তখন তিনি ভালো করেই জানেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এক নজিরবিহীন নৃশংসতা ঘটে গেছে ফিলিস্তিনের গাজাতে। শক্তিশালী বিস্ফোরকবাহী ইসরাইলি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত করেছে গাজার আরও একটি হাসপাতালে। আল আহলি হাসপাতাল, যার নাম এখন অনেকেই জানেন।
এই বিস্ফোরণ এতই শক্তিশালী ছিল যে, বিরাট হাসপাতালটি মূহূর্তের মধ্যে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এখানে শুধু রোগী ও জখমরাই ছিলেন না, এই হাসপাতাল চত্বর ও আশপাশে ইসরাইলি বোমা বর্ষণের ভয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন বহু নারী-পুরুষ-শিশু। তাদের ধারণা ছিল, আর যেখানেই হোক, ইসরাইল নিশ্চয়ই হাসপাতালে হামলা করার মতো পৈশাচিক বর্বরতায় লিপ্ত হবে না। তারা ভুয়ে গিয়েছিল, আগের দিনই ইসরাইল ফিলিস্তিনের গাজায় আরও ৯-১০টি ছোট হাসপাতালে বোমা ফেলেছে। আল আহলি হাসপাতালে এই হামলার ফলে প্রাথমিক খবরে জানা যায়, কম করে ৫০০ জন মারা গেছে। এখন বিশ্বস্ত সংবাদমাধ্যমগুলি জানাচ্ছে, নিহতের সংখ্যা ৭০০-তে পৌঁছেছে। আরও কত মানুষ যে নিহত হয়েছে, তা নিরুপণ করা সম্ভব হয়নি। কারণ, তারা ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে আছে।
ইরান স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে, এত ভয়ংকর বোমা সারা দুনিয়ায় কেবলমাত্র ইসরাইলের কাছেই রয়েছে। নিধনযজ্ঞের এই বর্বরতার সাক্ষী থাকল সারাবিশ্ব।
অনেকে ভেবেছিলেন, বিশ্ব মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট শান্তির জন্য কোনও ন্যায়সম্মত পরিকল্পনা পেশ করবেন। দেখা গেল, তিনি বিমান থেকে নেমেই ‘নরঘাতক’ নেতানিয়াহুকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাসি মুখে ছবি তুললেন। আর বাণী দিলেন, সব পরিস্থিতিতেই তিনি ইসরাইলের পাশে আছেন। অর্থাৎ জো বাইডেন ফিলিস্তিনবাসী ও আরবদের পাশে নেই।
তা বাইডেন কী বললেন? তিনি নেতানিয়াহুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আমি আপনাদের জানাতে চাই যে, আপনারা কোনও মতেই একা নন, আমরা সব সময় ইসরাইলের পিছনে রয়েছি। আপনারা আপনাদের জনগণের রক্ষার জন্য কাজ করছেন। আমরা পার্টনার হিসেবে এই এলাকায় আপনাদের সঙ্গে কাজ করব। যাতে আরও ট্র্যাজেডিকে প্রতিরোধ করা যায়।’
প্রশ্ন হল, কাকে বাইডেন এ কথা বললেন? বললেন, এই ‘নরঘাতক’ নেতানিয়াহুকে যিনি একের পর এক গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছেন। শিশু, নারী-ঘাতক হিসেবে যিনি সারাবিশ্বে স্বীকৃতি পেয়েছেন। তিনি নাকি আমেরিকাকে পার্টনার করে ট্র্যাজেডি রুখবেন!
বোঝা যায়, আরব ও মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে হান্টিংটন ৯০-এর দশকে যে ‘ক্ল্যাশ অফ সিভিলাইজেশন’ অর্থাৎ সভ্যতার সংঘাতের তত্ত্ব খাড়া করেছিলেন, জো বাইডেন তা বাস্তবায়িত করছেন।
জো বাইডেনের বক্তব্যে ফিলিস্তিনি মুসলিম ও আরবদের জন্য কোনও পয়গাম নেই। বোঝা যায়, আমেরিকা সুখে-দুঃখে গণহত্যাকারী ইসরাইলি নেতাদের পাশে রয়েছে। যারা হিটলারের নাজীবাদকেও ছাড়িয়ে গেছে। ফিলিস্তিনিদের উপর বিভিন্ন সময়ে তারা হলোকাস্ট সংঘটিত করেছে।
সবচেয়ে বড় কথা, জো বাইডেন ইসরাইলের জিওনিস্ট প্রোপাগন্ডাকেই সত্য বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি বললেন,গাজার ওই হাসপাতালে হামলা চালিয়েছে ‘অন্য পক্ষ’। নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকের মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যেই জো বাইডেন বললেন, নেতানিয়াহু আমাকে সমস্ত প্রমাণ দিয়েছে যে হাসপাতালে হত্যাযজ্ঞের জন্য ইসরাইল কোনও মতে দায়ী নয়। ব্যাস, মিটে গেল সবকিছু! নেতানিয়াহু হত্যাকারী নয়, যুদ্ধাপরাধী নয়। এই বিশাল মানবিক বিপর্যয়ের জন্য ইসরাইল দায়ী নয়। এই সার্টিফিকেট অম্লান বদনে দিলেন বিশ্ব মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।
শুনলে মনে হয়, হাসপাতালের হামলার দায় ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের উপরই চাপিয়ে দেওয়া হবে, এটা যেন ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের এক যৌথ প্রযোজনা! এই ধরনের মিথ্যার বেসাতি ইসরাইল তো আগেও করেছে। আর মুসলিম দেশগুলিতে হামলা চালানোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিথ্যা প্রচারণার কথা তো সচেতন মানুষ জানেন।
একটি উদাহরণ হল, সাদ্দাম হোসেনের কাছে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র রয়েছে। ইরাক আক্রমণের সময় এই ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম অজুহাত। সেই সময় মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের ডেকে সরাসরি স্যাটেলাইট থেকে তোলা চিত্র তুলে ধরেন। যাতে দেখা যাচ্ছে, সাদ্দাম হোসেনের গোপন আস্তানা থেকে বেশকিছু ট্রাক বেরিয়ে যাচ্ছে। যাতে রয়েছে কেমিক্যাল ও অন্য মারণাস্ত্র। আর যায় কোথায়! সারা পৃথিবীতে তা প্রচার হয়ে গেল যে, মানুষকে রক্ষা করার জন্যই সাদ্দাম হোসেনের ইরাকে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো নিতান্ত প্রয়োজন। পরে অবশ্য জানা যায়, এটা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ‘প্রোপাগন্ডা ওয়ার’ বা বানোয়াট প্রচারণা। কিন্তু ততদিনে সুসভ্য ইরাক প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। ভিয়েতনামেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একই কাজ করেছে।
এখন প্রচারণা হচ্ছে, গাজায় হাসপাতালে ‘ইসলামিক জিহাদ গোষ্ঠী’ বোমা মেরেছে। বোমা মেরেছে হামাস কিংবা তারাই ইসরাইলকে লক্ষ্য করে যে রকেট ছুড়েছিল, তা গিয়ে পড়েছে হাসপাতালের উপর। ফলে এই মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞ আল আহলি হাসপাতালে।
আবারও প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই ফিলিস্তিন সংকট? এর একমাত্র কারণ হল, ব্রিটেনের বালফোর ঘোষণাপত্র এবং পরবর্তীতে ব্রিটেনের সাহায্যে ফিলিস্তিনের ভূমিতে পৃথিবীর দূর-দূরান্ত দেশ থেকে ইহুদিদের এনে ফিলিস্তিনে বসানোর কাজ শুরু করে ব্রিটেন। ফিলিস্তিন তখন ইংরেজদের দখলে ছিল। ফিলিস্তিনবাসীকে হত্যা ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে উৎখাত করা হতে থাকে। আর পরে রাষ্ট্রসংঘকে দিয়ে ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি প্রস্তাব পাস করে যে, ফিলিস্তিনের ভূমিতে প্রতিষ্ঠা করা হল ইসরাইল রাষ্ট্রের। এটা হবে একটি ইহুদি রাষ্ট্র। আর সেখানে শত শত বছর ধরে বসবাসকারী মুসলিম ফিলিস্তিনিরা কোথায় যাবে, তার কোনও হদিশ বিশ্ব মোড়লরা দেয়নি। ফলে লক্ষ লক্ষ লোক আজ উদ্বাস্তু। আর উদ্বাস্তু শিবিরেও একের পর এক হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। চালিয়েছে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ। আর তাকেই স্বীকৃতি দিয়ে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারা ইসারইলের পাশে আছে।
আর একটি বড় ঘটনা হল, ভারসাম্য করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জর্ডনে কিছু আরব নেতার সঙ্গে বসতে চেয়েছিলেন। হাসপাতালের ঘটনার পর এই সব পদলেহী আরব নেতারাও বাইডেনের সঙ্গে বৈঠক করতে অস্বীকার করেছেন। তারা বুঝে গেছেন, যদি তাঁরা তাঁদের রক্ষাকর্তা আমেরিকার সঙ্গে বৈঠকে বসেন তাহলে জনগণের রোষে থেকে কেউ তাঁদের বাঁচাতে পারবে না। তবে এটা হয়তো ক্ষণিকের জন্য। কারণ, প্রতারকদের ছলের অভাব হয় না।
তাহলে ফিলিস্তিনিদের জন্য পথ কী?সেটা সুধী পাঠকরাই চিন্তা করুন।