আসিফ রেজা আনসারী: ভারতের চিরায়ত ঐতিহ্য হল বিবিধের মাঝে মিলন। কিন্তু একটা শ্রেণি এই সহাবস্থানমূলক পরিবেশকে বিষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। চারিদিকে হিংসা ছড়ানো হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে উত্তোরণের পথ নিয়ে রবিবার সন্ধ্যায় বিশেষ সিম্পোজিয়াম ছিল ‘পশ্চিমবঙ্গ মুসলিম মজলিশ-এ মুশাওয়ারাত’-এর। আলোচনাসভাটি হয় ভারতীয় জাদুঘরের আশুতোষ জন্মসতবার্ষিকী হলে।
এ দিনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ও বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোককুমার গাঙ্গুলি, রাজ্য সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক সাংসদ আহমদ হাসান ইমরান, বিহারের ইমাম বুখারী বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান শেখ মতিউর রহমান, রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী অধ্যাপক আবদুস সাত্তার, আয়োজক সংগঠনের জাতীয় সভাপতি অ্যাডভোকেট ফিরোজ আহমেদ, সম্পাদক এস এম জোহা, পশ্চিমবঙ্গ সভাপতি ডা. এম এন হক, সাধারণ সম্পাদক মানজার জামিল, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও দ্য ওয়্যারের সম্পাদক আরফা খানম শেরওয়ানি, সমাজকর্মী সন্দীপ পাণ্ডে, প্রাক্তন সাংসদ তারিক আনোয়ার, শিখ ধর্মগুরু জি. জারনেইল সিং, আখবার-ই-মাশরিক-এর সম্পাদক ওয়াসিমুল হক, প্রেস কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার সদস্য জয়শংকর গুপ্তা প্রমুখ।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই মানজার জামিল বর্তমান পরিস্থিতির উপর আলোকপাত করেন। তারপর আগামীর পথ নিয়ে কথা বলার জন্যেই তিনি বিশিষ্টদের কাছে আহ্বান জানান। বিচারপতি অশোককুমার গাঙ্গুলি অভিযোগ করেন, বর্তমানের শাসকগোষ্ঠী নিজেদের ফায়দার জন্যেই হিংসা ছড়াচ্ছে। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, আদালত আজকাল মন্দির তৈরির কথা বলছেন! তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট সদর্থক ভূমিকা পালন করছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। অন্য এক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশের সংবিধান সবাইকে সম্মানের জন্যে বাঁচা ও মিলিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার অধিকার দিয়েছে, এটাকে বাঁচাতে হবে। হিংসামুক্ত ভারত গঠনে সবাইকে মিলে প্রতিরোধ গড়ে তুলে হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
অন্যদিকে আরফা খানম শেরওয়ানি বলেন, ‘দেশে ঘৃণা ও সহিংসতার সবচেয়ে বড় প্রযোজক, পরিচালক এবং অভিনেতা ভারত সরকার নিজেই’। এ প্রসঙ্গে তিনি দাবি করেন, তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে তাঁর কাছে তথ্য ও পরিসংখ্যান আছে। তিনি হিন্দুত্ব-ওয়াচের একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে ভারতে ২৫৪টি ঘৃণা-ভাষণের ঘটনা ঘটেছে। আর এর ৮০ শতাংশই ঘটেছে বিজেপি-শাসিত রাজ্যে। তিনি ওয়াশিংটন পোস্ট-এর প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে বলেন, ২০১১ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত খ্রিস্টানদের উপর নির্যাতন চার গুণ বেড়েছে। ভোটের জন্য মুসলিমদের টার্গেট করার ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে। সমাধানের পথ হিসাবে তিনি বলেন, দেশের একটা বড় অংশের মানুষ অসাম্প্রদায়িক। তাদের কাজে লাগাতে হবে। মহিলাদেরও সঙ্গে নিতে হবে। কেন হিংসামুক্ত ভারতের আশাবাদী? এ প্রসঙ্গে আরফা খানম বলেন, কৃষক আন্দোলন ও এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলন মানুষকে পথ দেখিয়েছে। ফলে দেশের বিপদ সম্পর্কে সঠিক মেসেজ আমজনতাকে দিতে পারলেই বিভেদকামীরা পরাস্ত হবে। অন্যদিকে আলোচনায় প্রেস কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার সদস্য ও সিনিয়র সাংবাদিক জয়শঙ্কর গুপ্তা গুজরাত দাঙ্গা থেকে শুরু করে নানান ঘটনা তুলে ধরেন।
আলোচনায় পুবের কলম-এর সম্পাদক আহমদ হাসান ইমরান বলেন, এই মাসেই গান্ধিজীর জন্ম, বর্তমানে রবিউল আওয়াল মাস চলছে অর্থাৎ নবী মুহাম্মদ সা.-এর জন্মমাস। তাঁরা মানুষের জন্য কথা বলেছেন। নবী সা. সবাইকে ন্যায় দেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য দেশের বর্তমান পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। তিনি বিলকিস বানুর ধর্ষণকারীদের মুক্তি দেওয়ার প্রসঙ্গে তোলেন। অন্য প্রসঙ্গে বলেন, পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে আদালতেও ন্যায় পাওয়া যাচ্ছে না। আরএসএস-এর পক্ষ থেকে আইএএস ও জুডিশিয়ারির ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। সব জায়গা তারা দখল করছে। তিনি আরও বলেন, মিডিয়াকে ধংস করা হচ্ছে। ন্যায়ের মন্দির হিসাবে বিবেচিত পার্লামেন্টেও ঘৃণা-ভাষণ চলছে। ঘৃণা ও হিংসা চরম শিখরে চলে এসেছে। মণিপুরের জাতিগত সংহিংসতাকে ২০০২ সালের গুজরাতের সঙ্গে তুলনা করেন ইমরান। তাঁর মতে হিংসামুক্ত ভারত গড়তে হলে গণআন্দোলন দরকার। এতে গ্রামের মানুষ ও মহিলাদের সঙ্গে নিতে হবে বলেও উল্লেখ করেন ইমরান।
প্রাক্তন সাংসদ তারিক আনোয়ার বলেন, দেশের চলমান সাংস্কৃতিক ধারা ও সম্প্রীতির পরিবেশকে বিষাক্ত করে দেওয়া হয়েছে। তবে আশার কথা, এখনও ৬৩ শতাংশ মানুষ বিজেপির বিপক্ষে। মতিউর রহমান বলেন, সঠিক শিক্ষার পরিবেশ রচনা করতে হবে। তাহলেই বিভেদমুক্ত হবে দেশ। পড়ুয়াদের এমন পরিবেশ দেওয়ার জন্য তিনি নয়া বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির চেষ্টা করছেন বলেও জানান। অন্যান্যদের মধ্যে সাংবাদিক ওয়াসিমুল হক, সমাজকর্মী উজমা আলম, আইনজীবী খাজা জাভেদ ইউসুফ প্রমুখ, দেশের পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে সবাইকে নিয়ে হিংসামুক্ত ভারত গঠনের প্রচেষ্টার কথা বলেন।