পুবের কলম, ওয়েবডেস্ক: নিজ্জর খুনের কিনারা হয়নি। তা নিয়ে চিড় ধরেছে ভারত-কানাডা কূটনৈতিক সম্পর্কে। এমন পরিস্থিতিতে ফের খুন হল খালিস্তানপন্থী কানাডার নাগরিক। সে দেশের উইনিপেগ এলাকায় সুখদুল সিং ওরফে সুখা দুনেকের মৃত্যু হয়েছে একটি গ্যাং ওয়ারে। ভারতীয় মিডিয়া অন্তত তেমনটাই বলছে। ফলে ভারত-কানাডা দ্বৈরথ বৃহস্পতিবার আরও বাড়ল বলে মনে করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কানাডার নাগরিকদের ভিসা পরিষেবা বন্ধ করল কেন্দ্র সরকার। অনির্দিষ্টকালের জন্য এই পরিষেবা বন্ধ থাকবে বলে জানা গিয়েছে। দুই দেশের চাপানউতোরের মধ্যে ভারতের এই সিদ্ধান্ত কানাডাকে জোর ধাক্কা দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে সরকারি ভাবে এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেনি নয়াদিল্লি। ভিসা পরামর্শদাতা একটি বেসরকারি সংস্থা জানিয়েছে, আপাতত বন্ধ থাকবে ভিসা দেওয়ার পরিষেবা।
দেশি মিডিয়ায় প্রচার পঞ্জাবের মোগা জেলার অন্যতম কুখ্যাত গ্যাংয়ের সদস্য ছিল সুখদোল সিং। পাশাপাশি প্রকাশ্যে খলিস্তান দাবির জোরালো সমর্থকও ছিল সে। খলিস্তানপন্থী হরজিত সিং নিজ্জরও চলতি বছরের জুন মাসে প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীর হামলায় প্রাণ হারায়। তার মৃত্যুর পিছনে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ভারতের হাত রয়েছে বলে দাবি করেন। যাকে কেন্দ্র করে ভারত ও কানাডার কূটনৈতিক সংঘাত এখনও চলছে। এদিকে লরেন্স বিষ্ণোই গ্যাং এই খুনের দায় স্বীকার করেছে বলে দাবি করা হচ্ছে। জেলবন্দি কুখ্যাত গ্যাংস্টার লরেন্স বিষ্ণোইর বিরুদ্ধে পাঞ্জাবি গায়ক সিদ্ধু মুসেওয়ালা খুনের মূলচক্রী হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। একটি ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে লরেন্সের গ্যাং সুখদোল সিংকে খুনের দায় স্বীকার করেছে বলে খবর। যদিও তা সত্যি কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়।
খালিস্তানি নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যা নিয়ে দুই দেশের সম্পর্কে অবনতি হতে শুরু করে। কানাডা সরকারের ™াল্টা ভারতীয় বিদেশমন্ত্রক বুধবার অ্যাডভাইডজারি জারি করে কানাডায় ভারতীয় নাগরিক এবং ছাত্রদের সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করার জন্য উপদেশ দিয়েছে।
তবে ইতিমধ্যে ইস্যু হওয়া ভিসা বাতিল করার বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি। অর্থাৎ যাঁদের ভিসা আছে তাঁরা ভারত সফরে আসতে পারেন। আগামী সপ্তাহেই দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ২২টি দেশের সেনা প্রধানদের সম্মেলন। সেই সম্মেলনে কানাডার সেনা প্রধানের যোগ দেওয়ার কথা। এখনও পর্যন্ত সেই সফর বাতিলের কথা জানায়নি কানাডা।
এদিকে ভারত কানাডাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, নিজ্জর খুনের সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্কই নেই। তাঁর হত্যা গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফল। ভারতে নিষিদ্ধ বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘শিখস ফর জাস্টিস’ এর (এসএফজে) অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন নিজ্জর। গত জুনে ভ্যাঙ্কুভারের সারে এলাকায় গুরুনানক শিখ গুরুদ্বারের কাছে মুখোশধারী অজ্ঞাত আততায়ীর গুলিতে তিনি নিহত হন।
গত সোমবার কানাডার পার্লামেন্টে ভাষণ দেওয়ার সময় হরদীপ সিং নিজ্জরকে গুলি করে খুনের পিছনে ভারতীয় এজেন্টদের হাত থাকার অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো। এ বিয়ে তাঁদের হাতে ‘বিশ্বাসযোগ্য তথ্য’ রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
মঙ্গলবার তার নাগরিকদের জন্য একটি নির্দেশিকা জারি করেছে কানাডা সরকার। এতে কানাডা তার দেশের জনগণকে জম্মু ও কাশ্মীর ভ্রমণ না করতে বলেছেন। এর পেছনে নিরাপত্তাকে মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে কানাডা। অ্যাডভাইজারিতে লেখা হয়েছে, জম্মু ও কাশ্মীরে যাবেন না কারণ এখানে সন্ত্রাস, চরমপন্থা, নাগরিক অশান্তি এবং অপহরণের আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে, সংসদের বিশেষ অধিবেশন চলাকালীন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। এরপর থেকে কানাডার বিরুদ্ধে ভারত লাগাতার তৎপর রয়েছে। ভারত বলেছে যে অভিযোগ কানাডা তুলছে তার প্রমাণ তাদের দিতে হবে।
এর আগে ভারত সরকার গত ৫ বছরে খালিস্তানি সমর্থক এবং অপরাধমূলক কাজে যুক্ত ব্যক্তিদের প্রত্যার্পণের জন্য ২৬ বার চিঠি দিয়ে কানাডা সরকারের কাছে আবেদন করেছিল। কিন্তু ট্রুডো সরকার কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। নিরাপত্তা সংস্থাগুলির সূত্রে জানা গিয়েছে, ভারত জঘন্য অপরাধের জন্য ১৩ জন সন্ত্রাসী এবং অপরাধী কানাডায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। ১৩ জনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সন্দীপ সিং ওরফে সানি। তিনি কানাডা বর্ডার সার্ভিসেস এজেন্সিতে সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে কর্মরত।
ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোদের তির ছোড়ার আগে কানাডার সরকারি কর্তারা এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে তাদের মিত্র রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে (আমেরিকা-সহ একাধিক দেশ) দেখা করে কথা বলেছিলেন। ব্রিটেনের পর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার যে সব কথা বলেছে তা ভারতের পক্ষে যায়নি। অস্ট্রেলিয়ার বিদেশমন্ত্রী পেনি ওং বলেছেন, এই ধরনের রিপোর্ট উদ্বেগজনক এবং আমরা গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টির উপর নজর রাখছি। এই বিষয়ে, আমরা ভারতের বিদেশমন্ত্রীর কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেছি।’
ভারতীয় গোয়েন্দাদের অভিযোগ, বেশ কয়েক বছর ধরে পাঞ্জাব থেকে বিদেশে মানুষ পাচার বেড়ে গিয়েছে। অধিকাংশের গন্তব্য কানাডা। ২৯ জন অপরাধীর তালিকায় কানাডায় চলে যাওয়া অষ্টম ভারতীয় হিসেবে নাম রয়েছে সুখদুল সিংয়ের।
ভারতের শেয়ার বাজারে কানাডা ১.৭৭ লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। দুই দেশের মধ্যে চলতি অস্থিরতা সেই বিপুল বিনিয়োগকেও বড় ঝুঁকির সামনে ফেলে দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এছাড়াও কূটনৈতিক মহল বলছে, কানাডার সঙ্গে খলিস্তানি সন্ত্রাসবাদ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই জটিলতা বাড়ছিল। যা প্রশমিত করা সম্ভব হয়নি। অথচ কূটনীতির পাশাপাশি বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিষয়টিকে সমাধান করা বা প্রশমিত করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির ‘বিশ্বগুরু’ ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত কেন্দ্র সেই বিপদের বীজকে গুরুত্বই দেয়নি।