আহমদ হাসান ইমরান: মিজোরাম উত্তর-পূর্বের পাহাড় ও বনাঞ্চল-বেষ্টিত এক রাজ্য। আর নর্থ-ইস্ট ফ্রন্টিয়ার রেলওয়ে এখন মিজোরামকে ট্রেন দ্বারা যুক্ত করতে চাইছে। বলা হচ্ছে, এর দ্বারা এই রাজ্যের পর্যটন এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাট উন্নয়ন হবে। কেন্দ্রের পরিকল্পনা মতো নর্থ-ইস্ট ফ্রন্টিয়ার রেলওয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৮টি রাজ্যকে রেলের দ্বারা যুক্ত করার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে। বাইরাবী ও সায়রংকে যুক্ত করার জন্য ৫১ কিলোমিটার লম্বা এই রেলপথ তৈরি হচ্ছে। আর যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেই ব্রিজটি তৈরি হচ্ছিল কুরুং নদীর উপরে।
তা ভালো। মানুষে মানুষে, স্থানের সঙ্গে স্থানের সেতু নির্মাণ অবশ্যই ভালো কাজ। কিন্তু সেজন্য বেশকিছু মানুষকে প্রাণ দিতে হবে, তা কিন্তু মোটেই মেনে নেওয়া যায় না।
প্রশ্ন উঠবেই, যে শ্রমিক ও কারিগররা রেল লাইন ও ব্রিজ নির্মাণে এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছিলেন, তাদের নিরাপত্তার জন্য ভারতের রেলওয়ে মন্ত্রক কি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল? তাদের কি দুর্ঘটনা মোকাবিলার কোনও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল? এই মজদুর-কারিগরদের কি জানানো হয়েছিল, তাদের কাজটা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে? ওই প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই মজদুর-কারিগরদের থাকা-খাওয়া ও বিশ্রামের জন্য রেলওয়ে কী ধরনের ব্যবস্থা করেছিল? আর তা কি শ্রমিকদের প্রাপ্য অধিকারের উপযুক্ত ছিল? এসব প্রশ্ন করা হলে, রেলওয়ে মন্ত্রক কি বলবে আমরা বাপু এসব কিছু জানি না! ওই শ্রমিক-কারিগরদের তো আমাদের ঠিকাদাররা ভাড়া করেছিল। আমাদের তেমন কোনও দায়িত্ব নেই! আরও একটি প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, এই শ্রমিক-কারিগররা ওই রেলপথ নির্মাণের জন্য দৈনিক, সাপ্তাহিক বা মাসিক কত করে মজুরি পেত? তাদের জন্য কি কোনও বিমা করা হয়েছিল?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কিন্তু এসব প্রশ্নের সঠিক কোনও জবাব সামনে আসে না। দেখা যাচ্ছে, এই শ্রমিক-কারিগর-মিস্ত্রিরা সবাই হচ্ছে বাংলার মালদা জেলার। বামফ্রন্ট আমল থেকেই মুর্শিদাবাদ, মালদার প্রচুর মানুষ বিশেষ করে সংখ্যালঘুরা রাজ্যে তেমন রুজি-রোজগার না পেয়ে পরিযায়ী মজদুর-মিস্ত্রি হিসেবে ভিন্ন রাজ্যে পাড়ি দেওয়ার একটি ঐতিহ্য গড়ে তুলেছে। লেখাপড়া চুলোয় যাক, পেট তো ভরবে। বোনের বিয়ে হবে, সংসার গড়িয়ে চলবে।
অনেকে বলছেন, বাংলা থেকে যে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী, রাজমিস্ত্রি, সোনার কাজ, ফসল তোলা, রিকশাওয়ালা, গার্মেন্টস এসব কাজে বাইরে যাচ্ছে, তাদের কাছে কি তেমন কোনও বিকল্প রয়েছে?
যাই হোক, সে প্রশ্ন ভিন্ন। শুক্রবার বিকেলে বা সন্ধ্যায় বেশকিছু লাশ মালদা এসেছে। সাংসদ সামিরুল ইসলাম পুবের কলমকে মালদা থেকে জানালেন, ‘দুঃখের কথা, এই লাশগুলিকে শ্রমিকদের নিয়োগ কর্তা রেলওয়ে যেভাবে পাঠিয়েছে তা খুবই মর্মান্তিক। তাদের শরীর থেকে রক্ত মোছা হয়নি বা সম্মানজনকভাবে লাশগুলিকে ড্রেসিং করা হয়নি। খোদায় মালুম, যে দু-একজন জীবিত, জখম এখনও সেখানে রয়েছেন তাদের কী অবস্থা? তবে মালদা প্রশাসন এই নিহত শ্রমিকদের লাশগুলি ঠিকমতো পরিচ্ছন্ন করে মর্যাদার সঙ্গে গ্রামে তাদের স্বজনদের কাছে অ্যাম্বুলেন্সে করে পাঠিয়েছে।
হ্যাঁ, রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস মালদায় এসেছেন। তবে সার্কিট হাউসে থাকা সত্ত্বেও তিনি কিন্তু ওই নিহত শ্রমিক-মিস্ত্রিদের লাশের কাছে যাননি। তারা কিন্তু দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। এই শহিদদের দেখতে গেলে বাংলার রাজ্যপাল হিসেবে তাঁর মর্যাদা বাড়ত বইকি কমত না। আমাদের বীর সেনারাও দেশের জন্য পরিবার-পরিজন ছেড়ে কর্তব্যে রত থাকেন। হ্যাঁ, বেতন তাঁরা নেন। কিন্তু সেনাদের কাজের পরিমাপ কখনোই বেতনের মাপকাঠিতে করা সম্ভব নয়।