পুবের কলম প্রতিবেদক: পরিবারের প্রিয়জনকে এভাবে কফিনবন্দি লাশ হয়ে ফিরতে হবে স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি তাঁরা। শুক্রবার তাই মালদার রাতুয়ার ২ নম্বর ব্লকের পুখুরিয়া চৌদুয়ার কোকলামারি, ইংরেজ বাজার ব্লকের সাত্ত, গাজোলের আলিনগর, কালিয়াচক ২ ব্লকের পঞ্চান¨পুর এক নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের লস্করটোলা এখন শোকে পাথর। চোখের পানিতে দাফন করলেন প্রিয়জনকে।
নির্ধারিত সূচি মতোই শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ মালদার মেডিক্যাল কলেজে এসে পৌঁছয় পরিযায়ী শ্রমিকদের নিথর দেহ। সেখান থেকেই এই ১৮ জন শ্রমিকের দেহ জেলাশাসক নীতিন সিংহানিয়া, পুলিশ সুপার প্রদীপ কুমার যাদব, রাজ্যের মন্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন, ইংরেজ বাজার পুরসভার চেয়ারম্যান কৃষ্ণে¨ু নারায়ণ চৌধুরির উপস্থিতে তাঁদের বাড়ির লোকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। মিজোরাম থেকে বিশেষ অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশগুলি নিয়ে আসা হয়েছিল মালদা হাসপাতালের মর্গে। সেখান থেকে দেহগুলি পরিষ্কার করে যথাযথ মর্যাদার সাথে শববাহী গাড়িতে তুলে মৃতদেহগুলি তাদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়। মিজোরামে রেলব্রিজ দুর্ঘটনায় ২৪ জনের মৃত্যু হলেও এ দিন ১৮টি মৃতদেহ নিয়ে আসা হয়েছে। আজ শনিবার আরও ৪ জনের মৃতদেহ এসে পৌঁছবে। রবিবারে আরও একজনের দেহ আসার কথা।
এ দিকে, মিজোরাম থেকে যেভাবে দেহগুলি পাঠানো হয়েছে তা নিয়ে তীব্র ক্ষোভপ্রকাশ করেছেন তৃণমূল সাংসদ তথা রাজ্য পরিযায়ী কল্যাণ বোর্ডের চেয়ারম্যান সামিরুল ইসলাম। তাঁর অভিযোগ, মৃতদেহগুলিকে কোনও মর্যাদাই দেয়নি মিজোরামের পুলিশ-প্রশাসন। তারা এমনভাবে দেহগুলি পাঠিয়েছে যে তা থেকে রক্ত, রস রাস্তায় গড়িয়ে পড়ছে। স্থানীয় সূত্রে খবর, মালদায় আসা ১৮ জনের মৃতদেহের মধ্যে ৭জনের দেহ পৌঁছে যায় তাঁদের চৌদুয়ারের বাড়িতে। ১ জনের দেহ পৌঁছে যায় মোথাবাড়ির পঞ্চান¨পুরের লস্করিটোলা গ্রামে। ৫ জনের দেহ পৌঁছে যায় ইংরেজ বাজারের সাট্টারিতে। এ ছাড়াও পাথুরিয়ার নাগরাই, পাকুরিয়ার পীরগঞ্জ, গাজলের আলিনগর ও রতুয়ার পুরাণপুরে একজন করে শ্রমিকের দেহ পৌঁছে যায় তাঁদের বাড়িতে। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন চৌদুয়ার সাহিন আখতার। পড়াশোনায় মেধাবী। বেঙ্গালুরুতে পড়তে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। তাই টাকা জোগাড়ের জন্য গিয়েছিলেন মিজোরামে। ব্রিজ দুর্ঘটনা কেড়ে নিল তার জীবন।
এ দিকে, পরিযায়ী শ্রমিকদের দেহগুলি শাববাহী গাড়িতে করে গ্রামে ফিরতেই বুকফাটা কান্নার রোল। আর্তনাদ। এ দিন বিকেল থেকেই মৃতদের গ্রামগুলিতে ভিড়-জটলা বাড়তে থাকে। এরপর সময় যত গড়িয়েছে সেই ভিড় তত বেড়েছে। গ্রামের ছেলেদেরকে এভাবে শববাহী গাড়িতে দেখতে হবে তা মেনে নিতে পারছে না তারা।
তাঁদের একজন জানালেন, ছেলেগুলো একটু বাড়তি রোজগারের আশায় ভিনরাজ্যে কাজে গিয়েছিল। যাতে পরিবারে একটু আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আসে। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল। রাতুয়ার ২ নম্বর ব্লকের পুখুরিয়া চৌদুয়ার কোকলামারি এলাকায় পর পর কবর খোঁড়া হচ্ছে দাফনের জন্য। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তি ক্ষোভ উগরে দিয়ে বললেন, আর কতদিন ভিনরাজ্যে কাজে গিয়ে এভাবে তাঁদের গরিব ছেলেদের মরতে হবে? সরকার বলছে কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে না। একশো দিনের কাজ সেভাবে হচ্ছে না।
রাজ্য সরকার যদি এইসব ছেলেদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে তাহলে মালদা, মুর্শিদাবাদের মতো জেলার বহু গরিব পরিবার উপকৃত হবে। উল্লেখ্য, মিজোরামের রাজধানী আইজল থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে নির্মীয়মাণ রেলসেতু ভেঙে বুধবার শ্রমিকদের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল। বৃহস্পতিবারই আইজলের জেলাশাসক নাজুক কুমার জানিয়েছিলেন, ‘এখনও পর্যন্ত যাঁদের দেহ উদ্ধার করা গিয়েছে, তাঁদের সবাই পশ্চিমবঙ্গের মালদহর বাসিন্দা। যে ব্রিজটি তৈরি হচ্ছিল, সেটা দুর্গম জায়গায়। খাদ রয়েছে। ঝোপ রয়েছে। সেখানে আরও দেহ আটকে রয়েছে কি না, তা তল্লাশি চালিয়ে দেখা হচ্ছে।’
এ দিকে গোটা গ্রাম যে শোকে পাথর হয়ে রয়েছে, তার জ্বলন্ত প্রমাণ চৌদুয়ার প্রাইমারি স্কুল। সেখানে ২২৮ জন ছাত্রছাত্রী থাকলেও গত দু’দিন তাদের কেউ স্কুলে আসেনি। বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর মতো মানসিক অবস্থায় নেই তাদের অভিভাবকরা। গত বুধবার ১২টা নাগাদ মৃত্যুর খবর আসার পর থেকেই গ্রামজুড়ে কান্নার রোল। মৃত ১৪ জনের আত্মীয়-পরিজনরা রয়েছে এই গ্রামে। ফলে গোটা গ্রাম পরিজন বিয়োগ যন্ত্রণায় কাতর। একসঙ্গে এতজনের মৃত্যু আগে কখনও হয়নি। অনেকের বাড়িতে দু’বেলা উনুনে হাঁড়ি পর্যন্ত ওঠেনি।