পুবের কলম প্রতিবেদক: সিকেল সেল ডিজিজ। রক্তের এই অসুখ সিকেল সেল অ্যানিমিয়া নামেও পরিচিত। বাজেটে ঘোষণা করা হয়েছে, এই রোগটি নির্মূল করা হবে ২০৪৭-এর মধ্যে। এর জন্য ‘সিকেল সেল অ্যানিমিয়া এলিমিনেশন মিশন’-এর কথা বলা হয়েছে। সিকেল সেল অ্যানিমিয়া, এই রোগটি আসলে কী? কীভাবে রুখে দেওয়া যেতে পারে এই অসুখ?
বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন অংশের তরফে এমনই জানানো হয়েছে, ‘সিকেল সেল অ্যানিমিয়া এলিমিনেশন মিশন’-এর ঘোষণা করা হয়েছে বাজেটে। তবে, কীভাবে রক্তের এই অসুখ নির্মূল করা হবে, তার রূপরেখা জানা গেলে বিষয়টি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা হতে পারে।
মুকুন্দপুরে অবস্থিত বেসরকারি একটি হাসপাতালের হেমাটোলজি অ্যান্ড বিএমটি বিভাগের অধিকর্তা, চিকিৎসক প্রান্তর চক্রবর্তী বলেন, ‘সিকেল সেল অ্যানিমিয়া এবং থ্যালাসেমিয়ার মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে থ্যালাসেমিয়ায় সমস্যা যতটা দেখা যায়, সিকেল সেল অ্যানিমিয়ায় অতটা দেখা যায় না। পশ্চিমবঙ্গের কাছাকাছি থাকা প্রতিবেশী কিছু রাজ্যের কোনও কোনও জেলায় আছে সিকেল সেল অ্যানিমিয়া।’ তিনি বলেন, ‘আমরা যদি রোগটিকে চিহ্নিতকরণের চেষ্টা না করি তা হলে বুঝতে পারব না।
জনগোষ্ঠীর মধ্যে যখন কোনও জনস্বাস্থ্যের পদক্ষেপ নেওয়া হয় তাতে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ে। রক্তে শোর রোগ। এই রোগকে রুখে দেওয়া যায় কিংবা, এই রোগ থেকে সুস্থ হওয়া যায় এই পুরো বিষয়টি প্রাধান্য পাবে। যেহেতু এটা বাজেটের মধ্যে করা হয়েছে।’
কিন্তু, সিকেল সেল অ্যানিমিয়া, এই রোগটি আসলে কী? নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক, চিকিৎসক রাজীব দে বলেন, ‘এটা রক্তের একটা অসুখ। হিমোগ্লোবিনের সমস্যার কারণে এটা একটা জেনেটিক অসুখ।’
এ দিকে, সিকেল সেল অ্যানিমিয়া কত শতাংশ মানুষের রয়েছে এই বিষয়ে স্পষ্ট তথ্যের অভাব রয়েছে। কারণ, সিকেল সেল অ্যানিমিয়ার ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন এখনও সম্পূর্ণ হয়নি।
তবে, মোটামুটি ১-২ শতাংশ মানুষের মধ্যে সিকেল সেল অ্যানিমিয়ার বাহক আছেন। এই কথার পাশাপাশি চিকিৎসক রাজীব দে বলেন, ‘মূলত ট্রাইবাল পপুলেশনের মধ্যে সিকেল সেল অ্যানিমিয়া দেখা যায়। ভারতের কোনও কোনও রাজ্যে সিকেল সেল অ্যানিমিয়া খুব বেশি দেখা যায়। যেমন উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড, মধ্য প্রদেশের ট্রাইবাল এরিয়ায়, পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, মেদিনীপুর, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার। এই সব জায়গায় সিকেল সেল অ্যানিমিয়ার বাহক খুব বেশি দেখা যায়।”
লোহিত রক্তকণিকাগুলি বিশেষ বিশেষ অবস্থায় সিকেল অর্থাৎ, কাস্তের মতো হয়ে যায়। তখন ছোট ছোট শিরা, উপশিরাকে ব্লক করে দেয়। ব্লক করে দেওয়ার ফলে রক্ত চলাচল করতে পারে না। তখন মারাত্মক যন্ত্রণা হতে থাকে। যদি এই সমস্যা নিয়মিত হতে থাকে তা হলে বিভিন্ন অঙ্গের উপর এর প্রভাব পড়ে। ব্রেন থেকে শুরু করে কিডনি, বিশেষ করে হাড়ের উপর প্রভাব পড়ে।
তা হলে, চিকিৎসা হিসাবে কী রয়েছে? চিকিৎসক রাজীব দে বলেন, ‘হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম থাকলে, তা ১০-এর মধ্যে রাখতে হয়। ব্যথার জন্য ওষুধ দিতে হয়। অক্সিজেন দিতে হয়। কারণ, অক্সিজেন কমে গেলে সমস্যা বেশি হয়। কিছু ওষুধ আছে যেগুলি ফিটাল হিমোগ্লোবিন বাড়িয়ে দিয়ে সিকেল সেলের ক্রাইসিস কমিয়ে দেয়। নতুন একটি ওষুধ বেরিয়েছে সেই ওষুধ দেওয়া হলে সিকল সেলের পেইনফুল ক্রাইসিস ৪৫- ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘এগুলি সব সাপোর্টিভ ট্রিটমেন্ট। এ সবের কোনওটির মাধ্যমে রোগীকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব হয় না।’
বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন অংশের তরফে এমনই জানানো হয়েছে, সিকেল সেল অ্যানিমিয়ায় রোগীকে সুস্থ করে তোলার জন্য দুটি উপায় আছে। এক, বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট। এটা করলে সারিয়ে ফেলা সম্ভব। দ্বিতীয়, জিন থেরাপি। তবে, এটা এখনও গবেষণার স্তরে আছে। কিন্তু, প্রধান কাজ যেটা করা সম্ভব সেটা হল সিকেল সেল অ্যানিমিয়া নিয়ে যেন কারও সন্তানের জন্ম না হয়।
এই ক্ষেত্রে বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করে দেখা উচিত পাত্র-পাত্রী সিকেল সেল অ্যানিমিয়ার বাহক কি না। যদি দুই জনেই বাহক হন তা থ্যালাসেমিয়ার মতো তাঁদের সন্তানের ক্ষেত্রেও সিকেল সেল অ্যানিমিয়ার সমস্যা হতে পারে ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে। এই ক্ষেত্রে ভ্রূণ অবস্থায় ১১-১২ সপ্তাহের মাথায় যদি ভ্রূণের পরীক্ষা করা হয়, তা হলে দেখতে পাওয়া যাবে সিকেল সেল অ্যানিমিয়া নিয়ে, না এর বাহক হিসাবে, না কি নরমাল হিসাবে জন্ম হতে চলেছে। যদি দেখা যায় সিকেল সেল অ্যানিমিয়া নিয়ে জন্ম হতে চলেছে, তা হলে মেডিক্যাল টার্মিনেশন অফ প্রেগন্যান্সি আমরা করতে পারি ২৪ সপ্তাহ পর্যন্ত।
চিকিৎসক রাজীব দে বলেন, ‘সিকেল সেল রুখে দেওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। বিয়ের আগে থ্যালাসেমিয়ার মতো সিকেল সেল টেস্ট করা। স্বামী এবং স্ত্রী দু’ জনেই যদি বাহক হন, তা হলে ভ্রূণের পরীক্ষা করে দেখা।’ বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক এমনই জানিয়েছেন, থ্যালাসেমিয়া যেভাবে হয় সেভাবেই হয় সিকেল সেল ডিজিজ বা, সিকেল সেল অ্যানিমিয়া। এক্ষেত্রে উপসর্গ হিসাবে ছোটবেলা থেকেই অ্যানিমিয়া বা, রক্তাল্পতা হবে, জন্ডিসের ভাব থাকবে, কোমর হাত-পা সহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা হতে পারে। শ্বাসকষ্ট হতে পারে। এই ক্ষেত্রে ফুসফুসের শিরা-উপশিরাগুলি সিকেল সেলের মাধ্যমে ব্লক হয়ে থাকলে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। সাপোর্টিভ ট্রিটমেন্ট চলতে থাকলে সিকেল সেল অ্যানিমিয়া নিয়েও মোটামুটি স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। এখন যে সব ওষুধ পাওয়া যায়, তাতে অন্তত ৪০-৫০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারেন।