দেবশ্রী মজুমদার, রামপুরহাট: একটি জাতির পরিচয় বহন করে তার ঐতিহাসিক স্থাপনা। যা মানুষের মনের মধ্যে স্থায়ী আসন লাভ করে। যেমন মরক্কোর ফেজ শহরে পৃথিবীর প্রাচীনতম আল কারাওয়াইন বিশ্ববিদ্যালয়।
নালন্দার অর্থ জ্ঞান বিতরণ। তক্ষশীলাও সেই একই কাজে নিযুক্ত ছিল। আরবি শব্দ দারুল হুদার অর্থ ‘জ্ঞানালয়’। যিনি জ্ঞান লাভ করেন, তিনিই তো ভাগ্যবান। সেদিক থেকে দারুল হুদা ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় একই পথের শরিক।
মুরারইয়ের ভীমপুর এখন বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও ধার্মিক সৌন্দর্যের মধ্যে গড়ে ওঠা শৃঙ্খলা বোধের আরেক নাম। এখানে ছত্রিশ বিঘা জমির উপর গড়ে উঠেছে বয়েজ ক্যাম্পাস ও সত্তর লক্ষ টাকা ব্যয়ে আধুনিক মানের কমিউনিটি কিচেন। কিন্তু এখানেই থামার কথা ভাবতে চায় না দারুল হুদা বিশ্ববিদ্যালয়। সাত কোটি টাকা ব্যয়ে ত্রিতল মহিলা ক্যাম্পাস তৈরির কাজ চলছে। সেখানে তিনশো মেয়ে বিনা পয়সায় থেকে পড়াশোনা করতে পারবে। বালিকা আবাসিক গড়ে উঠলে এলাকার শিক্ষা ব্যবস্থায় ছাত্রীরা অনেকটাই এগিয়ে যাবে।
এছাড়াও বিশ বিঘা জমির উপর গড়ে উঠবে একটি মেডিক্যাল ক্লিনিক সেন্টার, একটি ল্যাব ও ম্যাটারনিটি সেন্টার। একটি মোবাইল ভ্যান সবসময় মজুত থাকবে। সেই ভ্যান গ্রামগঞ্জে ঘুরে অসহায় মানুষকে চিকিৎসা পরিষেবা দেবে। কেরলের ড. আজাদ মোপেন পৃথিবীর বহু জায়গাতে হাসপাতাল গড়েছেন। তিনি এবার আগ্রহী হয়েছেন দারুল হুদার বেঙ্গল ক্যাম্পাসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে।
তিন হাজার বর্গফুট এলাকায় গড়ে ওঠা কমিউনিটি কিচেন বিল্ডিং দারুল হুদা ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্বের প্রথম সোপান। বিশাল কিচেন কম্পাউণ্ড ও মহিলা ক্যাম্পাস হবে তার দ্বিতীয় গর্ব। তারপর দারুল হুদা মেডিক্যাল কলেজও একদিন বিকশিত হবে। সেই পথে একটু একটু করে এগোচ্ছে দারুল হুদা বেঙ্গল ক্যাম্পাস।
বিশ বিঘা জমি পুরোটা দান করছেন স্থানীয় বাসিন্দা বিজ্ঞানী মুনকির হোসেন এই মহতী কাজের জন্য। প্রথমে একটি ক্লিনিক ও একটি মোবাইল ভ্যান দিয়ে কাজ শুরু করে। সমাজসেবার মাধ্যমে তার ভবিষ্যৎ সমুজ্জ্বল করতে চায় এই ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে মোবাইল ভ্যান গ্রামে গিয়ে মানুষের চিকিৎসা করবে। কেন, তার উত্তর দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃষ্ঠপোষক মুনকির হোসেন। যিনি মানবতার সেবায় সাবলীল। তিনি মনে করেন, উইদ আউট সায়েন্স ইসলাম ইজ লেইম। এখন মানুষকে বোঝাতে গেলে ধর্মের ব্যুৎপত্তি দিয়ে কাজ হবে না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মধ্য দিয়ে ইসলামকে বুঝতে হবে।
বিজ্ঞানের শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্যবোধ না গ্রহণ করে আমরা মনোরঞ্জনটাকেই গ্রহণ করে থাকি। বিনোদন জীবন নয়। গলাধঃকরণ জীবন নয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিও ঈশ্বরকে অস্বীকার করে না। বিজ্ঞানের শৃঙ্খলার মতো ধর্মের শৃঙ্খলাবোধ দরকার। অর্থকরী লাভ জীবনের মূল কথা নয়। প্রকৃতির মধ্যে সমস্ত সৃষ্টি বিজ্ঞানের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। সেই সৌন্দর্য যদি আমার মধ্যে না থাকে, তাহলে কিসের সৃষ্টি। আমরা হয়তো শিখছি অনেক, কিন্তু অনুশীলন কই? রিপুর ঝংকারে তা কি করে সম্ভব? কি করে সৃষ্টিকর্তার বোধের সংস্কৃতি জাগরূক হবে?
মানবতাহীন মানুষ সবার নীচে। সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি আর ফলোয়িং দ্য রুলস অফ নেচার। তারপর আবেগমথিত হয়ে মুনকির সাহেব বলে ওঠেন, স্যরি! আমি ইমোশনাল হয়ে গিয়েছি। যে কাজ মানুষের করা উচিৎ, সেটা চোখের সামনে দেখতে পেলে আবেগতাড়িত হওয়া স্বাভাবিক। তাই বলি, ড. আজাদ মোপেনের সহায়তায় এখানে ক্লিনিক হবে, ল্যাব হবে, বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র হবে। এখানে তিনতলা বিল্ডিংয়ে তিনশো মেয়ের জন্য আবাসিক হবে। মেঝে পর্যন্ত হয়েছে। তিনশো মেয়ের থাকা-খাওয়া সব হবে। ব্যয় হবে সাত কোটি টাকা। ছত্রিশ বিঘার পর আরও কুড়ি বিঘায় এই মেডিক্যাল কলেজ হবে। শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয়, দেড়শো টপিক নিয়ে আলোচনা হয় এই বিশ্ব বিদ্যালয়ে।
উল্লেখ্য, কেরলের মাল্লাপুরমে অবস্থিত দারুল হুদা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের বিভিন্ন প্রসিদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্তৃক অনুমোদিত। দারুল হুদার অধীনে বর্তমানে চলছে ২৪টি অনুমোদিত কলেজ। কেরল ছাড়াও কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং অসমেও এর শাখা খোলা হয়েছে। পশ্চিম বাংলার বীরভূমে প্রথম ক্যাম্পাস শুরু হয় ২০১০ সালে। এখানে বিনা খরচে প্রাইমারী থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত পড়ানোর ব্যবস্থা রয়েছে।