পুবের কলম প্রতিবেদকঃ শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন (১৮৮০-১৯৬০) ছিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. অমর্ত্য সেনের মাতামহ (নানা)।
ক্ষিতিমোহন তাঁর ‘হিন্দু-মুসলমানের যুক্তসাধনা’ গ্রন্থে জানাচ্ছেন, সম্প্রীতি রক্ষায় যৌথভাবে কাজ করাটা জরুরি। বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করলে দেখা যাবে দুই সম্প্রদায়ের পারস্পরিক সহযোগিতার ইতিহাস অত্যন্ত দীর্ঘ। হিন্দুদেরকে রাজসভায় উচ্চপদে আসন দিয়েছিলেন মুসলমান রাজা-বাদশাহরা। শুধু তাই নয়, জ্ঞানচর্চা, চিত্রকলা, স্থাপত্য, সংগীতসহ নানা ক্ষেত্রে পরস্পর যুক্তভাবে কাজ করে গেছে। রামায়ণ ও মহাভারতের সংস্কৃত থেকে বাংলায় তরজমার কাজ শুরু হয়েছিল হোসেনশাহী আমলে মুসলমান শাসকদের নির্দেশে। এভাবে ধার্মিকতার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা ধর্মের বাইরে গিয়েও নানা উপাদানগুলোর সঙ্গে নিজেদেরকে যুক্ত করেছেন। এটাই যুক্তসাধনা।
বর্তমান প্রেক্ষিতে সহিষ্ণুতা ও সম্প্রীতি নিয়ে যখন জোর চর্চা চলছে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে বিভাজিত এই দেশে, তখন ফের একবার ‘যুক্তসাধনা’র কথাই স্মরণ করালেন ভারত তথা বিশ্ব বিবেকের কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক ড. অমর্ত্য সেন।
রবিবার অপরাহ্নে সল্টলেকের অমর্ত্য সেন রিসার্চ সেন্টারের ছোট অডিটোরিয়ামে পা দেওয়ার জায়গা ছিল না। বিভিন্ন স্কুল কলেজের পড়ুয়া ও শিক্ষকদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো।
পাশাপাশি অধ্যাপক সেনের মননশীল কথা শোনার আগ্রহে উপস্থিত হয়েছিলেন প্রাক্তন সাংসদ আহমদ হাসান ইমরান, অধ্যাপক আমজাদ হোসেন, মানবী মজুমদার, মুহাম্মদ রিয়াজের মতো বিদগ্ধ ব্যক্তিরা। সাবির আহমেদ, মানবেশ সরকারের পরিচালনায় সুচারুভাবে শুরু হয় অনুষ্ঠানটি।
এদিনের আলোচনার বিষয় ছিল ‘যুক্তসাধনা’ কোলাবরেশন ইন ডাইভারসিটি’। প্রতীচী ট্রাস্ট ও ‘নো ইয়োর নেইবার’ নামের একটি অলাভজনক সংস্থা এই আয়োজন করেছিল। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই আলোচনা যে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অমর্ত্য সেনের বক্তব্যের পাশাপাশি বর্তমান প্রজন্ম বিষয়টি নিয়ে কী ভাবছে, তা শোনার জন্য এই অনুষ্ঠান এক দারুণ উদ্যোগ। তাই প্রথমেই অনুষ্ঠানটিকে যুক্তসাধনা ও বিশ্বপ্রেমের বোধে উন্নীত করার জন্য অর্থনীতির অধ্যাপক সেঁজুতি গাইলেন ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারও/ সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও’ এবং ‘এ কি সুন্দর শোভা’ রবীন্দ্র সংগীত দুটি। এর পরপরই বিশ্বভারতীর অধ্যাপক বিশ্বজিৎ রায় আচার্য ক্ষিতিমোহন সেনের চিন্তাভাবনা তুলে ধরেন সংক্ষেপে।
যখন ইংরেজরা এ দেশে আসেনি, তখন হিন্দু-মুসলিম কীভাবে পরস্পরের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসেছে, তা নিজের লেখাপত্রে তুলে ধরেছিলেন অমর্ত্য সেনের মাতামহ। তিনি বিশ্বাস করতেন, আরব দেশে যে মারামারি, হানাহানি চলছিল, তা মুহাম্মদ সা. দূর করতে চেয়েছিলেন মৈত্রী ও শান্তি-সাধনার মাধ্যমে।
চর্চার বিভিন্ন ক্ষেত্রে পাঠান, মুঘলদের সঙ্গে হিন্দুদের যুক্তসাধনার কথাই বারবার উঠে আসে এখানে। এরপরই আসে পড়ুয়াদের সরাসরি প্রশ্নোত্তর পর্ব।
অমর্ত্য সেনের কাছে তাদের প্রশ্ন ছিল? সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তচিন্তাধারার প্রসার ও যুক্তসাধনার জন্য কী করণীয়, অধ্যাপক সেন জবাবে বলেন, এই সময়ে অপরের বক্তব্য শুনতে আপত্তি হচ্ছে। প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা দেওয়ার ক্ষমতা কমেছে। বিভিন্ন দলের মধ্যে যে ঝগড়াঝাটি, তার কারণটা কী?আমাদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করার ব্যাপারটি খুব গাম্ভীর্যপূর্ণ বিষয় নয়। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দূরত্ব কমাতে হবে, তবেই সম্ভব হবে এই সাধনা।’
ড. সেনের মতে, এক ধরনের ‘অবৈচিত্রতা’ ভারতকে কাবু করে ফেলছে। আমদেরকে এরই মাঝে আশাবাদী হতে হবে। আশাবাদ খুঁজলে হবে না শুধু, এর যোগ্য পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আর সেটা যুক্তসাধনার মাধ্যমেই সম্ভব।