আহমদ হাসান ইমরান
প্রিন্স হ্যারি প্রায়ই খবর কাগজের শিরোনামে থাকেন। তাঁর স্ত্রী মেগানের বদনাম প্রতিরোধ এবং রাজপরিবারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের তথ্য ফাঁস সংবাদপত্রের হেডিংয়ে আসার মুখ্য কারণ। তবে দিন দুয়েক আগে হ্যারি তাঁর একটি আত্মজীবনীমূলক পুস্তকে যে তথ্য দিয়েছেন, তা সত্যিই বিস্ফোরক।
হ্যারি তাঁর আত্মজীবনী ‘স্পেয়ার’-এ সদর্পে লিখেছেন, ‘আফগানিস্তানে দখলদারি বজায় রাখার অভিযানে ব্রিটিশ সেনার সঙ্গে তিনিও অংশ নিয়েছিলেন।’ আর তাঁর বীরত্বমূলক কর্ম হল, হ্যারি কমপক্ষে ২৫ জন আফগানকে নির্বিচারে হত্যা করেছেন। এই মানবহত্যার জন্য রাজকুমার হ্যারি বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। ‘দাবার বোর্ডে যেমন করে এক একটি গুটি বা বোড়েকে অপসারণ করা হয়’, হ্যারি আফগানদের হত্যাকে তেমনই এক তুচ্ছ পদক্ষেপ ভেবেছেন। এর সঙ্গে মানবাধিকার কিংবা মানুষের জীবনের যেকোনও সম্পর্ক আছে, ব্রিটেনের রাজকুমার হ্যারি তা বিন্দুমাত্র মাত্র বিবেচনায় আনেননি। বরং তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে আরও লিখেছেন, ‘বর্তমানের ল্যাপটপ বা অ্যাপাচি হেলিপক্টারের (যা থেকে নিচে গুলি করে হত্যালীলা চালানো যায়) যুগে সহজেই এটা নিশ্চিতভাবে জানা সম্ভব যে, কতজন মানুষকে আমি হত্যা করলাম। আর এটা আমার কাছে খুববেশি জরুরি যে, হত্যাকৃতদের সংখ্যা গোনার পর ভীত না হওয়া। তাই আমি জোরের সঙ্গে বলব, আমরা হত্যাকৃত সংখ্যাটি হচ্ছে ২৫। আমি এই ২৫ জন লোককে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করি না। তবে এই সংখ্যাটিতে আমি সন্তুষ্ট নই। আর ২৫ জনকে হত্যা করেছি বলে আমি অস্বস্তিতেও নেই।’
পরে প্রিন্স হ্যারি স্বীকার করেন, যে সমস্ত লোককে গুলি করা হয়েছে তাদেরকে তিনি ‘মানুষ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেন না। তিনি বলেন, ‘পরে যখন আমি যুদ্ধের মাঝে একটু বিহ্বল হয়ে পড়ি, আমি মোটেই ওই ২৫ জন লোকের কথা চিন্তা করি না। তারা ছিল নিতান্তই আমার দাবার বোর্ড থেকে অপসারিত গুটি মাত্র। অন্য ভালো মানুষকে হত্যা করার আগে আমি তাদের হত্যা করেছি।’
স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, হ্যারি ‘সন্তুষ্ট’ নন, তাঁর ইচ্ছে ছিল আরও অনেক বেশি আফগানকে হত্যা করার যাদের মূল্য তাঁর কাছে দাবার ছোট গুটির থেকে বেশি কিছু নয়। পাশ্চাত্যের কিছু মহলে রাজকুমার হ্যারির বক্তব্যের নিন্দা করা হয়েছে। তাদের অনুরোধ হল, হ্যারি আফগানিস্তানে তাঁর হত্যালীলা প্রকাশ করে দিয়ে রাজ পরিবারের সুরক্ষাকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। এখন তালিবানরা বদলা নেওয়ার জন্য প্রিন্স হ্যারি এবং সঙ্গে রাজ পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে পালটা হামলা চালাতে পারে।
অনেকে আবার বলছেন, হ্যারি তাঁর হত্যাকাণ্ডের বিবরণ প্রকাশ করে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সুনাম এবং খ্যাতিকে তলানিতে পৌঁছে দিয়েছেন। তবে একটা কথা জানা যাচ্ছে, ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া প্রভৃতি স্থানে হামলা চালাবার সময় ব্রিটেন-সহ পশ্চিমারা মানুষের সঙ্গে যে অমানুষি আচরণ করতেন, হ্যারি তার কিছুটা হলেও পর্দা উন্মোচন করেছেন। আবু ঘারিব বা গুয়ানতানামো বে নয়, পশ্চিমা সরকার ও সেনাবাহিনীর অমানুষিক নৃশংসতা সকলেই জানেন। কিভাবে তারা শুধুমাত্র মজা পাওয়ার জন্য নির্বিচারে কোনও পরিবারকে বা কিশোরদের হত্যা করেছে, তা সংবাদপত্রের বিভিন্ন রিপোর্টে সামনে এসেছে। আফগানিস্তানে বিয়েবাড়িতে ইচ্ছে করে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
পশ্চিমা সেনাবাহিনী যে যুদ্ধাপরাধী তাতে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। কিন্তু এদের বিচার হবে কি? তারা যে সাদা চামড়ার মানুষ! তাই হত্যালীলার কথা রাজকুমাররা গর্বের সঙ্গে সারা পৃথিবীকে জানাতে পারেন। অবশ্য পশ্চিমাদের একেবারেই বিচার বা মূল্যবোধ নেই, তা কিন্তু ঠিক নয়। হিটলারের নাৎসি বাহিনীর কাউকে কোনওভাবে চিহ্নিত করতে পারলেই হল। তাকে তৎক্ষণাৎ ধরে সারা জীবনের জন্য কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তা সে সরাসরি খুনখারাবির সঙ্গে যুক্ত থাকুক কিংবা নাই থাকুক। যত দোষ নাৎসিদের। একই অপরাধে চিহ্নিত রাজকুমারদের নয়। ব্রিটেন ও আমেরিকা-সহ পশ্চিমা শক্তিগুলি সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া ও ফিলিস্তিনে তাদের সহযোগী ইসরাইল কয়েক লক্ষ নারী ও শিশুকে হত্যা করেছে। বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে তাদের জীবনকে তছনছ করে দিয়েছে। ক্ষুধা, চিকিৎসার অভাব ও শীতে হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু এসব কথা বলা যাবে না। বললেই আইএস জঙ্গি বলে আপনাকে গুয়ানতানামো বে বা আবু ঘারিবে পাঠিয়ে দেবে।