বিশেষ প্রতিবেদকঃ পূর্ব ভারতের অসম রাজ্যে চলতি বছরের মাঝামাঝি অন্তত চারটি মাদ্রাসা ভেঙে ফেলা হয়েছে। সরকারি মাদ্রাসা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং বেসরকারি কওমী মাদ্রাসারও গণনা এবং নথিভুক্ত করার কাজ চলছে। যদিও সংখ্যালঘুদের নিজস্ব উদ্যোগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, পরিচালনা করার অধিকার সংবিধানই দিয়েছে। আর বলা হয়, মাদ্রাসার মান ও শিক্ষা উন্নত নয়। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, অসমে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা স্কুলগুলির পরিকাঠামো খুব ভালো অবস্থায় আছে।
দিন কয়েক আগে বিধানসভায় অসমের শিক্ষামন্ত্রী রানোজ পেগু-র বিবৃতি থেকেই পরিষ্কার যে, ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) শাসিত রাজ্যটিতে স্কুলশিক্ষা পরিকাঠামোর অবস্থা বর্তমানে খুবই খারাপ। শিক্ষামন্ত্রী পেগু জানিয়েছেন, অসমে ৩,০০০-এর বেশি ছাত্রদের স্কুলে এবং ১,৬০০টির বেশি ছাত্রীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শৌচালয় নেই।
বস্তুত শিক্ষামন্ত্রী পেগু যে তথ্য দিয়েছেন, তা বিস্মিত করেছে রাজ্য তো বটেই, গোটা দেশের মানুষকে। পেগু জানিয়েছেন, ১১০০টির বেশি স্কুলে পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই, বিদ্যুৎ নেই ১০০০-এর বেশি স্কুলে। অসমে মোটামুটিভাবে ৫০,০০০-এর বেশি প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক ßুñল রয়েছে।
এ ছাড়া রাজ্যে ২,৯৭৯টি স্কুলে মাত্র ১ জন শিক্ষক বা শিক্ষিকা রয়েছেন। ১৫,০০০-র বেশি স্কুলে রয়েছেন ২ জন এবং ৮,০০০-র বেশি স্কুলে রয়েছেন মাত্র ৩ জন শিক্ষক বা শিক্ষিকা।
শুধু ২,৯১৬টি স্কুলে যথেষ্ট পরিমাণে শিক্ষক বা শিক্ষিকা রয়েছেন, এর হার স্কুল প্রতি ৭ জন। বিদ্যালয়ে বিদ্যুৎ না থাকাকে একটা বড় সমস্যা বলে চিহ্নিত করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আগামী বছরের জানুয়ারির মধ্যে স্কুলগুলিতে বিদ্যুৎ পৌঁছনোর চেষ্টা করা হচ্ছে। কংগ্রেস বিধায়ক ও রাজ্য বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা দেবব্রত শইকিয়ার এক প্রশ্নের উত্তরে এই তথ্য দেন শিক্ষামন্ত্রী পেগু।
মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা মুসলিম মহিলাদের লক্ষ্য করে বলছেন, ইমাম-জোনাব নয়, আপনারা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারের জন্ম দিন। অনেকেই বলছেন, মাদ্রাসাগুলি থেকেও যে ডাক্তার, ব্যারিস্টার, বিজ্ঞানী গবেষক, অধ্যাপক হয়েছেন এমন অসংখ্য নজিরের কথা কী অসমের মুখ্যমন্ত্রী জানেন না? আবার কেউ কেউ বলছেন, হিমন্ত বিশ্ব শর্মার হাতেই ধ্বংসের পথে গিয়েছে অসমের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা। তিনি কংগ্রেস শাসনে তরুন গগৈ মন্ত্রিসভার শিক্ষা মন্ত্রী ছিলেন ১০ বছরের বেশি সময়। আবার বিজেপি শাসনের প্রথম ৫ বছরেই শিক্ষা দফতরের দায়িত্বও ছিল হিমন্ত বিশ্ব শর্মার হাতে। তিনি এ’ন অসমের মুখ্যমন্ত্রী। আর তাঁর শাসনে রাজ্যের সরকারি শিক্ষার হাল যে কতটা খারাপ তার প্রমাণ মিলেছিল গত মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশিত হওয়ার পর। সেই রেজাল্টে দেখা যায় অসমের তিনশোর বেশি সরকারি স্কুলে একজন ছাত্রছাত্রীও মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি!
প্রশ্ন হল, স্কুলগুলির যখন এই অবস্থা তখন দীর্ঘদিন ধরে চলা মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে রাজ্যে কেন বিনষ্ট করা হচ্ছে? ২০২০ সালে অসম বিধানসভায় একটি আইন পাস হয়। এই আইনে বলা হয়েছিল সরকারি অনুদানে চলা মাদ্রাসাগুলোকে ‘নিয়মিতভাবে চলা স্কুলে’ পরিণত করা হবে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে গুয়াহাটি হাইকোর্ট এই আইনকে বলবৎ রাখে। এই বছরের সেপ্টেম্বরে রানোজ পেগু-ই জানান, ব্যক্তিগত অনুদান, অর্থাৎ প্রধানত জাকাতের টাকায় চলা মাদ্রাসাগুলিকেও নথিভুক্ত করা হবে। যেহেতু সরকারের খাতায় নথিভুক্ত হওয়া মাদ্রাসাগুলিকে আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তাই মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এ নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। অসমের মুসলমান সম্প্রদায় মনে করে বেসরকারি মাদ্রাসাও এখন বন্ধ করে দেওয়ার তোড়জোড় চলছে। পাশাপাশি এই বছরই অন্তত চারটি মাদ্রাসা ভেঙে ফেলা হয়েছে। এর ফলে মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীরাও সাধারণ স্কুলে যেতে শুরু করেছে। কিন্তু এখন শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার যে, অসমে সাধারণ বিদ্যালয়গুলির পর্যাপ্ত পরিকাঠামো নেই।
অসমের মাদ্রাসাগুলির শিক্ষাব্যবস্থা খুবই উন্নত ছিল। এখানে আরবি ও কুরআন-হাদিস পড়ানো হত ঠিকই, কিন্তু সব বিষয় ছিল স্কুলেরই মতো। প্রত্যন্ত এলাকায় এবং চর অঞ্চলে এইসব মাদ্রাসা নিরক্ষরতা দূর করেছে, শিক্ষার প্রসার ঘটিয়েছে এবং বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত এই মাদ্রাসাগুলি বন্ধ করে দিয়ে এবং বেসরকারি মাদ্রাসাগুলিকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা অসলে সংখ্যালঘুদেরই উন্নয়ন ও বিকাশকে নিশানা করেছেন। গণতান্ত্রিক ভারতে এই ধরনের কাজ যে মারাত্মক অপরাধ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।