আনজুমান বানু, বর্ধমান: ভাবতেও অবাক লাগে আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে আমাদেরই সমাজের এক বাঙালি রমণী নারী শিক্ষার প্রসারে এতখানি তৎপর হয়েছিলেন। মাত্র ৫২ বছরের জীবত্কালে আজও তিনি স্মরণীয়। বাঙালি সমাজের বিশেষ করে নারী শিক্ষার অগ্রদূত হিসেবে তাঁর স্থান সবার উপরে। পর্দা প্রথাকে কখনও প্রগতির অন্তরায় ভাবেননি তিনি বরং আপন সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত পরিবারের ট্র্যাডিশনকে কিছুটা আদর্শ মেনেই পর্দার মধ্যে থেকে চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন জ্ঞান অর্জনের এবং পরবর্তীকালে তা প্রচার ও প্রসারের।
ভাবতে হবে, যুগটা ছিল আজ থেকে দেড়শ বছর আগের। আমাদের সমাজে নারী শিক্ষা তো দূর-স্থান, পুরুষদের শিক্ষাও ছিল অনেক কষ্টের। সে দিক থেকে বেগম রোকেয়ার পরিবার ছিল অনেক এগিয়ে। বিচার বিভাগীয় কাজে মুঘল সম্রাটদের অধীনে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষেরা। আর তাঁর পিতা জহীরুদ্দীন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার ছিলেন একজন শিক্ষানুরগী মানুষ। আরবি, উর্দু, ফারসি, বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন তিনি। বেগম রোকেয়ার বড়ো দুই ভাই মোহাম্মদ ইব্রাহীম আবুল আসাদ ও খলিলুর রহমান আবু যায়গামের পড়াশোনা ছিল সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। ফলে ইংরেজি শিক্ষা ও সভ্যতার সঙ্গে তাঁদের পরিচয় ঘটে এবং তা তাঁদের চিন্তাচেতনাকে প্রভাবিত করে। বেগম রোকেয়ার বড় বোন করিমুন্নেসার কথা না বললেই নয়, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা হয়তো তিনি লাভ করেন নি, কিন্তু গৃহ পরিবেশ এবং নিজস্ব প্রচেষ্টায় তাঁর বিদ্যা শিক্ষা ছিল অনেকের থেকে এগিয়ে। এরকম এক পরিমণ্ডলে বেগম রোকেয়ার বেড়ে ওঠা।
১৮ বছর বয়স তখন তাঁর। বিয়ে হয় বিহারের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট শাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। তাঁর সাহচর্যে এসে বেগম রোকেয়ার জ্ঞানচর্চার পরিধি আরও বিস্তৃত হয়। উদার ও মুক্তমনের অধিকারী স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতায় রোকেয়া দেশি-বিদেশি লেখকদের রচনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হন এবং ক্রমশ ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, স্বামী-সঙ্গ ও তাঁর অনুপ্রেরণা বেশি দিন বেগম রোকেয়ার কপালে জুটলো না। ১৮৯৮ এ বিয়ে হয় তাঁদের আর ১৯০৯ সালের ৩ মে সাখাওয়াৎ হোসেন মারা যান।
স্বামীর মৃত্যুর পর নিঃসঙ্গ রোকেয়া নারীশিক্ষা বিস্তার ও সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। স্বামীর প্রদত্ত অর্থে পাঁচটি ছাত্রী নিয়ে তিনি ভাগলপুরে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস’ স্কুল স্থাপন করেন। কিন্তু সেটাও বেশিদিন স্থায়ী হলো না। পারিবারিক কারণে ছাড়তে হলো ভাগলপুর। কলকাতায় এসে শুরু করেন স্থায়ী বসবাস। কলকাতার ওয়ালিউল্লাহ লেনের একটি বাড়িতে মাত্র আটজন ছাত্রী নিয়ে নতুনভাবে শুরু করলেন লড়াই, প্রতিষ্ঠা করলেন ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’। প্রায় দু যুগ ধরে বেগম রোকেয়া তাঁর সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন স্কুল পরিচালনায়। বিরূপ সমালোচনা ও নানাবিধ সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে তিনি এই প্রতিষ্ঠানটিকে সে যুগে মেয়েদের শিক্ষালাভের অন্যতম পীঠস্থানে পরিণত করেন। এটি ছিল তাঁর স্বপ্ন ও আদর্শের বাস্তবায়ন।
বেগম রোকেয়া পর্দার অন্তরালে থেকেই নারীশিক্ষা বিস্তারে প্রয়াসী হন। প্রথমদিকে কেবল অবাঙালি ছাত্রীরাই পড়ত সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল স্কুলে। বেগম রোকেয়ার অনুপ্রেরণায় ক্রমশ বাঙালি মেয়েরাও এগিয়ে আসে পড়াশোনার জন্য। ছাত্রীদের পর্দার ভিতর দিয়েই ঘোড়ার গাড়িতে করে স্কুলে আনা-নেওয়া করা হত। সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল স্কুলে তফসিরসহ কুরআন পাঠ থেকে আরম্ভ করে বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, ফারসি, হোম নার্সিং, ফার্স্ট এইড, রান্না, সেলাই, শরীরচর্চা, সঙ্গীত প্রভৃতি বিষয়ই শিক্ষা দেওয়া হত।
তাঁর সাহিত্য প্রতিভাও ছিল দেখার মতো। আসলেই তিনি চেয়েছিলেন নানান কুসংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। নারী জাতিকে শিক্ষিত করার মাধ্যমেই তা ত্বরান্বিত হতে পারে বলে, ছিল তাঁর গভীর বিশ্বাস। তাই তিনি সামগ্রিকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এগিয়ে গিয়েছিলেন লেখনীর মাধ্যমে সমাজকে জাগরণের পথ দেখাতে। তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে সমাজের কুসংস্কার ও অবরোধ প্রথার কূফল, নারীশিক্ষার পক্ষে তাঁর নিজস্ব মতামত, নারীদের প্রতি সামাজিক অবমাননা এবং নারীর অধিকার ও নারী জাগরণ সম্পর্কে তাঁর প্রাগ্রসর ধ্যানধারণা। বাল্যবিবাহ এবং বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধেও তাঁর লেখনী ছিল সোচ্চার। সবদিক থেকেই বেগম রোকেয়া ছিলেন এক ব্যতিক্রমী প্রতিভা।