বিশেষ প্রতিবেদকঃ শহিদ টিপু সুলতানের পরিবারকে সুদূর কর্নাটক থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল বাংলায়। আজাদি সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্যই টিপু সুলতানের পরিবারকে কলকাতায় নির্বাসন দেওয়া হয়। সেই কর্নাটক থেকে এবার হিজাব নিষিদ্ধ করার দাবি দেখা গেল সম্প্রীতির রাজ্য পশ্চিমবাংলাতেও। ঘটনাটি ঘটেছে হাওড়ার ধূলাগড়ি আদর্শ বিদ্যালয়ে। যার জেরে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রদের আঘাতে মাথা আবৃত করা এক ছাত্রী মাফুজা সেখ অজ্ঞান হয়ে যায়। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। আর এর জেরে স্কুল কর্তৃপক্ষ স্কুল বন্ধ থাকবে বলে ঘোষণা করেছে। যে নির্ধারিত টেস্ট পরীক্ষা ছিল তাও বাতিল হয়ে গেছে।
কি ঘটেছিল ধূলাগড়ি আদর্শ বিদ্যালয়ে?
স্কুলের পোষাক নয়, নামাবলি পরে কয়েকজন পড়ুয়া প্রবেশ করেছিল স্কুলে।তার প্রতিবাদ করেছিল অন্য পড়ুয়ারা। আর তাতেই তৈরি হল বির্তক। এমনকি হাতাহাতিতেও জড়িয়ে পড়ে ছাত্রছাত্রীরা। নামাবলির পক্ষে ছিল মূলত উঁচু ক্লাসের ছাত্ররা। আর মাথা আবৃত করে স্কুলে আসার ঐতিহ্য পালনে উন্মুখ ছিল ছাত্রীরা। ঘটনার জেরে ভাঙচুর করা হয় স্কুলের আসবাবপত্র। এই ঘটনার ফলে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্কুল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ।স্কুল বন্ধের নোটিশ টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে স্কুলের বাইরে। ঘটনার সূত্রপাত সোমবার। স্কুল সূত্রে জানা গেছে, ধূলাগড়ি আদর্শ বিদ্যালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক টেস্ট পরীক্ষার চলছে।
সোমবার বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর দু’জন পড়ুয়া নামাবলি পড়ে স্কুলে আসে। বিষয়টি দেখে কয়েকজন পড়ুয়া শিক্ষকদের জানায়। ওইদিন স্কুলের শিক্ষকরা ওই ছাত্রদের নামাবলি খুলে আসার নির্দেশ দেন। সেই সময় ওই নামাবলি পরিহিত পড়ুয়ারা আপত্তি তোলো, স্কুলে অন্য পড়ুয়ারা যদি হিজাব পরে আসে তাহলে তারাও নামাবলি পরেই স্কুলে আসবে। ওই দিনকার মতো বিষয়টি মিটে গেলেও মঙ্গলবার আবার ও দ্বাদশ শ্রেণীর কয়েকজন ছাত্র নামাবলি পরে স্কুলে প্রবেশ করে। মঙ্গলবার এর প্রতিবাদ করে ছাত্রীরা। সেই প্রতিবাদেই তৈরি হয় বিতর্ক। একে অপরের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে। প্রাথমিকভাবে ঝামেলা মেটানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় স্কুলের শিক্ষকরা। খবর দেওয়া হয় সাঁকরাইল থানায়। স্কুলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে সাঁকরাইল থানার পুলিশ।
যদিও মুসলিম পড়ুয়া ও অভিভাবকদের অভিযোগ, পুলিশ বেছে বেছে মুসলিম পড়ুয়াদের মেরেছে। ঘটনার সময় বিদ্যালয়ের সিসি ক্যামেরাও ভেঙে দেওয়া হয়। এই সংঘর্ষে গুরুতর আহত হয় দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী মাফুজা সেখ। সে ঘাড়ে আঘাত পায়। স্কুলে অশান্তির খবর পেয়ে ছুটে যান মাফুজার পরিবারের লোকজন। আহত অবস্থায় তাকে তুলে এনে পরিবারের লোকজন ভর্তি করে সাঁকরাইলের একটি হাসপাতালে। মাফুজার মা হাপিজা বেগম বলেন, মেয়েকে বুধবার দুপুরে হাসপাতাল থেকে ছুটি দিয়েছে। তিনি বলেন, স্কুলে মেয়েকে পড়াশোনার জন্য পাঠিয়েছি আমরা। কিন্তু এই ঘটনায় খুবই আতঙ্কিত হয়েছি। আর ওই স্কুলে মেয়েকে পাঠাবো না। তিনি আরও বলেন, স্কুলে পড়াশোনার পরিবেশ ফিরে আসুক এটা সকলেই চায়।
এদিকে অভিযোগ উঠেছে, মঙ্গলবার ঘটনার সময় স্কুলে প্রবেশ করে বেশকিছু বহিরাগতরা। তাদের দ্বারাও আক্রান্ত হয়েছেন পড়ুয়ারা বলে অভিযোগ। পুলিশের বিরুদ্ধে পড়ুয়া বিশেষ করে সংখ্যালঘু পড়ুয়াদের উপর লাঠিচার্জের অভিযোগ উঠেছে।এদিকে মঙ্গলবার ঘটনার পর বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির বৈঠক হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যে স্কুলের ইউনিফর্ম পরেই ছাত্র-ছাত্রীদের আসতে হবে। বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক অরিন্দম মান্না বলেন, বিষয়টি প্রশাসনের সব মহলকে জানানো হয়েছে। আপাতত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কোনও ধর্মীয় পোশাক পরে স্কুলে আসতে পারবে না পড়ুয়ারা। আপাতত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে স্কুল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমরা অভিভাবকদের নিয়ে আলোচনায় বসে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব। জানা গেছে, ধূলাগড়ি আদর্শ বিদ্যালয়ের পড়ুয়ার সংখ্যা কম-বেশি এক হাজার। টেস্টের এখনো দু’টি পরীক্ষা বাকি ছিল। তার মাঝেই পোষাক বির্তকে বন্ধ হয়ে গেল স্কুল।
এই এলাকাটি পড়ে ধূলাগড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে। এরপর পার্শ্ববর্তী গ্রাম পঞ্চায়েত কান্দুয়া। এই গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার প্রচুর ছেলেমেয়ে এই স্কুলে পড়াশোনা করে। পঞ্চায়েতের প্রধান অলক কুমার দেটি বলেন, স্কুলে পড়াশোনার পরিবেশ ফিরে আসুক। এই ঘটনা সম্পর্কে হাওড়া সিটি পুলিশের এক কর্তা বলেন, পোষাক নিয়ে একটা বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। আপাতত চারদিন স্কুল বন্ধ রাখা হয়েছে। আমরা বিষয়টির উপর নজর রাখছি। হাওড়ার তৃণমূল কংগ্রেসের মন্ত্রী অরূপ রায় সাংবাদিকদের বলেন, বহিরাগতরা এসে ক্যাম্পাসের মধ্যে অশান্তি করার চেষ্টা করে। কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
এই ঘটনা বেশ কয়েকটি প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে। স্থানীয় ছাত্রীরা, তারা হঠাৎ মাথা আবৃত করে স্কুলে আসেনি। মুসলিম ছাত্রীরা সাধারণত মাথা আবৃত করে বা স্কার্ফ পরে স্কুলে আসে। তারা স্কুল ইউনিফর্ম পরেই মাথায় কাপড় ব্যবহার করে। এতে কারও কোনও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আর যতদিন পর্যন্ত না গেরুয়া দলগুলি মুসলিম ছাত্রীদের স্কার্ফ পরার ক্ষেত্রে আপত্তি জানায়নি, ততদিন পর্যন্ত ভারতবর্ষের কেরল, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, দিল্লি প্রভৃতি রাজ্যে এটাই হচ্ছে মুসলিম মেয়েদের প্রথা। বিশেষ করে বাংলার জেলাগুলিতে মুসলিম মেয়েরা মাথা কাপড় দিয়ে আবৃত করে। এটা তাদের ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধ। মাথা আবৃত করতে না দেওয়ায় কর্নাটকসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রচুর সংখ্যক মুসলিম ছাত্রীর লেখাপড়াই বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ, তারা বিবেক ও মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে শিক্ষা গ্রহণে রাজি হয়নি। আশা করা যায়, পশ্চিমবঙ্গে এই ধরনের অবস্থা হবে না। যারা নামাবলি পরে স্কুলে আসতে চায়, তাদেরকেও নামাবলি পরার স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। কারণ, নামাবলি খারাপ কিছু নয়। তাতে কৃষ্ণ ও রামের নাম লিখিত থাকে। যারা নামাবলি পরে স্কুলে আসার আপত্তি জানাচ্ছে, তাদের সবদিক বিবেচনা করে আপত্তি পরিহার করা উচিত।