পুবের কলম, ওয়েবডেস্কঃ এটা কি মিয়া মিউজিয়াম হয়েছে সেটা বুঝতে পারলাম না। লাঙলটা তো অসমিয়া মানুষের। মাছ ধরতে ব্যবহার করা যেগুলি জিনিস রাখা হয়েছে সেগুলি অসমিয়া মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা, যিনি সম্প্রতি মিয়া মুসলমানদের ভূমিপুত্রের স্বতন্ত্র মর্যাদা দিলেন।
অসমের গোয়ালপাড়ায় অভিবাসী মুসলিমদের সংস্কৃতি সুরক্ষার স্বার্থে নির্মিত ‘মিয়া মিউজিয়াম’ বা সংগ্রহশালা বন্ধ করে দেওয়ার দাবি জানিয়েছিল শাসক দল বিজেপি। তাদের দাবি মেনে সরকার মঙ্গলবারই সিল করে দিয়েছে মিউজিয়াম। উদ্বোধনের মাত্র দু’দিনেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে মিউজিয়াম এবং মিউজিয়ামের মালিককে পুলিশ আটক করেছে।
অল অসম মিয়া পরিষদের প্রেসিডেন্ট মোহর আলি তৈরি করেছিলেন এই মিউজিয়াম। তাঁর বিরুদ্ধে বিজেপির অভিযোগ ছিল, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় বরাদ্দ থাকার ঘরে মোহর আলি মিউজিয়াম তৈরি করেছেন। কিন্তু ঘটনা হল, ২৩ অক্টোবর মিউজিয়ামটির উদ্বোধনের পর থেকেই একে বন্ধ করার দাবি তুলেছিল বিজেপি।
‘মিয়া’ শব্দ ব্যবহার করে থাকেন অসমীয়রা মুসলিমদের জন্য। শব্দ ব্যবহার করা হয় এখন খুব নিন্দনীয় অর্থে, যদিও শব্দটির অর্থ হল ‘ ভদ্রলোক’ কিংবা ‘মহাশয়’।
ইংরেজ আমলে বাঙালি মুসলিমদের জন্য মিয়া শব্দ ব্যবহৃত হত সদর্থক অর্থেই। এই মিয়াঁ বা মুসলমানদের ব্রিটিশরা চাষাবাদের কাজের জন্য অসমে নিয়ে এসেছিল ১৮৯০-এর দশকে। তারপর থেকে এরা কয়েক পুরুষ ধরে অসমের বাসিন্দা। কিন্তু বিজেপি সরকার এই বাংলাভাষী মুসলমানদের ব্যাপারে এতটাই নির্দয় যে, এদের সবাইকে বাংলাদেশি বলতেও কুণ্ঠাবোধ করে না।
বিজেপি, বিশেষ করে হিমন্ত বিশ্ব শর্মার মুখ্যমন্ত্রিত্বের কালে চায় না কোনও মুসলিম অসমে থাকুক কিংবা তাদের সাংস্কৃতিক কোনও প্রতীকের অস্তিত্ব বেঁচে থাকুক। তাই এনআরসিতে বারবার মুসলিমদের নাম কাটার অভিযোগ ওঠে এবং তাদের নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে দ্বারস্থ হতে হয় আদালতের।
মোহর আলির বাড়িতে মিয়া মিউজিয়াম সিল করে দেওয়ার পর তাঁর দুই ছেলে মিউজিয়ামের সামনে ধরনায় বসেছেন। মোহর আলি বলেছেন, মিয়াদের ব্যবহৃত জিনিসগুলি তিনি মিউজিয়ামে রেখেছিলেন যাতে স্থানীয় লোকেরা বুঝতে পারেন যে, মিয়ারা তাদের থেকে আলাদা নয়। তাঁরাও অসমের বাসিন্দা। যেসব জিনিস মিয়া মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হয়েছিল তার মধ্যে লাঙল, মাছ ধরার বর্শা, পীঠেপুলি, লুঙ্গি, গামছা ইত্যাদি।
অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা মিউজিয়াম বন্ধ করে দেওয়াটাকে সমর্থন করে বলেছেন মিয়ারা কীভাবে ‘লাঙল’কে নিজেদের বলে দাবি করতে পারে। লাঙল তো সবাই ব্যবহার করে। তারা শুধু ‘লুঙ্গি’কে তাদের নিজস্ব বলে দাবি করতে পারে।
এর উত্তরে অন্য এক মুসলিম নেতা আবদুল বাতেন বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রী বুঝতে পারেননি যে মিয়াঁরা ‘লাঙল’ প্রদর্শিত করে এই বার্তাই দিতে চেয়েছে যে অসমের মূল নিবাসীদের সঙ্গে তাদের কোনও পার্থক্য নেই।
হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেছেন, এই মিউজিয়াম তৈরি করতে টাকা কে দিয়েছে তার তদন্ত করে দেখবে পুলিশ। কংগ্রেসের প্রাক্তন বিধায়ক শেরমান আলি বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রী শর্মা বাঙালি মুসলিমদের সঙ্গে অসমিয়াদের পার্থক্য করতে চাইছেন। তাঁর মন্তব্যের অর্থ হল এটা প্রমাণ করা যে মিয়ারা আসলে ভারতীয় নন। উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে হিন্দুত্ববাদীদের এটা এক খুবই পরিচিত দাবি।
প্রসঙ্গত, ২০২০ সালে এই শেরমান আলি গুয়াহাটিতে শ্রীমন্ত শংকরাদেব কলাক্ষেত্রে মিয়াঁ মিউজিয়াম গড়ার সর্বপ্রথম প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বিধানসভার শিল্প ও সংস্কৃতি সংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটি ২০২০ সালের ২৪ মার্চ বিধানসভায় প্রস্তাব করেছিল চর-চাপোরিতে একটি মিয়া মিউজিয়াম গড়ে তোলার।
কিন্তু সেই প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা। কারণ বাঙালি মুসলিমদের বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে মনে করে শাসক দল বিজেপি।
মিয়া মিউজিয়াম নিয়ে শুরু হওয়া বিতর্কে মুখ খুললেন কংগ্রেস বিধায়ক নুরুল হুদা। তাঁর প্রশ্ন, মিয়া কারা? মিয়া বলে কোথাও কোনও জাতি আছে নাকি? এটি মুসলিমদের ভাষা করার ষড়যন্ত্রী, এই ষড়যন্ত্রের গতিপথ বেঁধে দিয়েছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী, মিয়া অর্থাৎ অসমিয়া ভাষী মুসলিমদের ভূমিপুত্রের স্বীকৃতি দিয়ে।