পুবের কলম ওয়েব ডেস্ক, দ্বীন দুনিয়া: আজ ১২ রবিউল আউয়াল। রবিউল আউয়াল ইসলামি সনের তৃতীয় মাস। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর জন্ম ও ওফাতের মাস হিসাবে রবিউল আউয়াল মাস মুসলিমদের কাছে বিশেষ মর্যাদার মাস।
ইসলামের দাওয়াত নিয়ে তায়েফে গিয়েছিলেন রাসূল মুহাম্মদ সা.। তায়েফের বাসিন্দারা তাঁর উপর লেলিয়ে দিয়েছিল কিছু আক্রমণকারীকে। তাদের প্রস্তরাঘাতে রক্তাক্ত হয়েছিল নবী সা.-এর শরীর। ফেরেশতা জিবরাঈল আ. মহানবীকে বলেছিলেন, তাঁর ইচ্ছে হলে তায়েফবাসীকে চরম শাস্তি দিতে পারেন। কিন্তু দয়ার নবী সা. ক্ষমা করে দিয়েছিলেন তায়েফের অধিবাসীদের। সেই ঘটনা নিয়ে এই নিবন্ধ। লেখাটি মরহুম চৌধুরি আবদুর রহিম সাহেবের। তিনি ছিলেন ইলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি, ছিলেন এক পরহেজগার ব্যক্তিত্ব।
মক্কায় যখন দ্বীন প্রসারের সব দ্বার রুদ্ধ, কোরেশরা অপরপক্ষে যখন অত্যাচার চালাচ্ছে ইসলামের গতিরোধ করার জন্য, তখন নবী সা. সিদ্ধান্ত নিলেন মক্কার বাইরে গিয়ে দাওয়াতের কাজ চালাবেন। নিজের আত্মীয়-স্বজনরা বোঝেনি, বুঝতেও চায়নি। অতএব, তায়েফের লোকজন স্বাগত জানাবে কিনা তার নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু তিনি (সা.) জানতেন তাঁর কাজ মেহনত করা, হেদায়েত আল্লাহর হাতে। তিনি ধৈর্যের পাহাড় ছিলেন। তিনি সঙ্গে একজন খাদেম নিয়ে হাজির হলেন সেখানে। সেটা নবুয়তের নবম বছর। উদ্দেশ্য ছিল সেখানকার বিখ্যাত সাখিফ গোত্রের লোকদের দাওয়াত দেওয়া। তায়েফে পৌঁছে নবীজি সা. তিনজন গোত্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন এবং তাদের দ্বীনের দাওয়াত দিলেন। কিন্তু তারা গ্রাহ্য করল না।
ওর মধ্যে একজন বলল : ‘নবী করে পাঠাবার জন্য আল্লাহ্ বুঝি তোমাকে ব্যতীত আর কোনও লোক পাননি।’ অন্য লোকেরাও আলাপ করতে রাজি হল না। তারা তাঁকে শহর থেকে বেরিয়ে যেতে বলল। ফেরার সময় পাড়ার দুষ্টু ছেলেরা ইট-পাথর মারতে লাগল। তাঁর শরীর থেকে রক্ত ঝরতে লাগল এবং রক্তে জুতো ভিজে গেল। এরূপ ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় শহর ছেড়ে বেরিয়ে এসে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে বসে পড়লেন। দোয়া করলেন : ‘হে আল্লাহ্! আমার দুর্বলতা ও অসহায়তার জন্য তোমার দরবারে অভিযোগ জানাই। তুমি কার হাতে আমাকে সোপর্দ করেছো। যদি তুমি আমার উপর অসন্তুষ্ট না থাক, তবে আমি কারও-র পরোয়া করি না। তোমার অসন্তুষ্টিকে সন্তুষ্টিতে পরিবর্তন করা আমার কামনা।’ (সারাংশ)
হযরত জিব্রাইল আ. হাজির হয়ে আরজ করলেন, ‘আল্লাহ্পাক তায়েফবাসীদের দুর্ব্যবহার লক্ষ্য করেছেন এবং পাহাড়সমূহের খিদমতে ন্যস্ত এক ফেরেশতা পাঠিয়েছেন। আপনি নির্দেশ দিলে উভয় পার্শ্বের পাহাড় মিলিয়ে দিয়ে ওদের পিষে ফেলতে পারি।’ কিন্তু রহমাতুল্লিল আলামিন উত্তর করলেন : ‘আমি আল্লাহ্র দরবারে এই আশা পোষণ করি যে, যদি এরা ইসলাম গ্রহণ না-ও করে, তবুও তাদের বংশধরদের মধ্যে এমন লোক পয়দা হোক যারা একমাত্র আল্লাহ্র বন্দেগী করবে।’ (সংক্ষিপ্ত)
তায়েফ মক্কা থেকে সড়ক যোগে বর্তমানে ৮৮ কি.মি. দূরত্বে। সম্পূর্ণ পাহাড়ী পরিবেশ। উচ্চতা ৬,১৬৫ ফুট। ১৯৭৭ সালের সেন্সাস অনুযায়ী, লোক সংখ্যা ২ লাখ ৪ হাজার। জেদ্দা-রিয়াধ হাইওয়ে এখন তায়েফের মধ্য দিয়ে লম্বিত। জেদ্দা ১৮৮ কি.মি. দক্ষিণ-পূর্বে এবং রাজধানী রিয়াধ ১০০০ কি.মি. উত্তর-পশ্চিমে। তখন তায়েফ ছিল মক্কা থেকে উটের পিঠে ২/৩ দিনের পথ। সব থেকে সোজা রাস্তা ছিল আরাফাতের ময়দানের মধ্য দিয়ে, কা’বা পর্বত ডিঙিয়ে। কেবলমাত্র খচ্চররাই পার হতে পারত। মক্কা থেকে বিকেলে বেরিয়ে কাবা পর্বতমালার নীচে রাত কাটিয়ে পরদিন সকাল থেকে চড়াই ভাঙতে শুরু করলে দুপুর নাগাদ তায়েফ পৌঁছান যেত। আরবের অন্যান্য শহরগুলির মতো তায়েফ ছিল কতগুলো গ্রামের সমষ্টি। এক একটির দূরত্ব ছিল ১-২ ফার্লং। এক একটি গ্রামে এক একটি গোষ্ঠী বসবাস করত। প্রত্যেকটি গ্রামে ছিল বাগ-বাগিচা, কৃষিজমি, দুর্গ ও প্রহরামঞ্চ। ওয়াজী নদীর পানি থেকে ওইসব বাগান, জমি সেচ করা হ’ত।
পারস্য সম্রাটের সাহায্যে এখানে একটি দুর্গ স্থাপিত হয়। তায়েফ কথাটির মানে হল ‘প্রাচীরবেষ্টিত’। এই অঞ্চল উর্বরতার জন্য বিখ্যাত ছিল, সেজন্য অনেকে বাইরে থেকে এসে এখানে বসতি স্থাপন করে। তাই তৎকালে এখানে দুই ধরনের লোক পাওয়া যেত— বনু মালিক এবং আহলাফ (মানে সহযোগী)। দুর্গের মধ্যে লাত ও ওজ্জার মন্দির ছিল। ওই দুর্গ এখন নিশ্চিহ্ন। সেখানে এখন সরকারি অতিথিশালা ও বাজার নির্মিত হয়েছে। ইবনে আব্বাসের মসজিদের কাছে মুসলিম শহিদদের কবর দেখা যায়, যাঁরা নবী সা.-এর সময়ে তায়েফ অবরোধকালে নিহত হয়। হুনাইনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল মাউন্ট আওয়াহাসের নিকট (ইবনে হিশাম)।
শত্রুপক্ষ পরাজিত হলে মুসলিম বাহিনী পশ্চাদ্ধাবন করতে থাকলে হাওয়াজিনদের একটি দল তায়েফের দুর্গে আশ্রয় নেয়। নবী সা. তায়েফের দুর্গ অবরোধ করেন। ইবনে হিশাম উল্লেখ করেছেন যে, নবী সা.-এর শিবির ইবনে আব্বাসের মসজিদের স্থলে স্থাপন করা হয়েছিল। অবরুদ্ধ দুর্গ এত কাছে ছিল যে, দুর্গ-মধ্য হতে নিক্ষিপ্ত তির, লোহার কীল মুসলিম শিবিরে আঘাত হানতে থাকে। নবী সা. কাঠের পাটাতন দিয়ে শিবির ঘিরে দেওয়ার নির্দেশ দেন।
আরব ভূমিতে দুর্গের সংখ্যা খুব কম। সুতরাং, দুর্গ অবরোধ করা সেই যুগে আরব সৈন্যদের কাছে নতুন বিষয় ছিল। খয়বরের পরে তায়েফ দ্বিতীয় দুর্গ যেখানে তাঁকে প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়। খয়বরের যুদ্ধে হস্ত নির্মিত যন্ত্র দ্বারা নিক্ষিপ্ত প্রস্তর বর্ষণে মুসলিম বাহিনীর প্রচুর ক্ষতি হয়। সেই অভিজ্ঞতা থেকে নবী সা. তায়েফ অবরোধের সময় প্রস্তর খণ্ড ছোড়ার জন্য অনুরূপ যন্ত্র ব্যবহার করেন (তাবারী)।
বালাযুরী লিখেছেন, তায়েফ-এ ব্যবহৃত ওই যন্ত্র সালমান ফারসী রা. নির্মাণ করেন। দাবাবাহ্ নামে বিশেষ প্রকারের আচ্ছাদনযুক্ত গাড়ি (অনেকটা আর্মার্ড ভেহিকলের মতো, কিন্তু ইঞ্জিন বিযুক্ত) ব্যবহার করেছিলেন খালেদ ইবনে সাদ, জুরস্ বা জারস থেকে আমদানি করে। ওই অবরোধকালে দাবাবাহ্ এবং প্রস্তর ছোড়ার যন্ত্রের কারিগরী বিদ্যা আয়ত্ত করার জন্য দু’জন তায়েফবাসী জুরস্ যান। কিন্তু যখন ফিরে আসেন তখন অবরোধ সমাপ্ত। কিন্তু অতবড় শহরের অবরোধ বা প্রতিরোধ চূর্ণ করার জন্য ১/২টি ওই ধরনের যন্ত্র যথেষ্ট ছিল না। তায়েফবাসীদের খাদ্য-শস্যের ভাণ্ডারও ছিল অফুরন্ত। এজন্য তারা ছিল নিশ্চিন্ত। তারা হাতাহাতি লড়াই-এর জন্য দুর্গ থেকে বের হয়নি। অপরপক্ষে দুর্গ প্রাকার থেকে নিক্ষিপ্ত শরে মুসলিম বাহিনীর ক্ষয়-ক্ষতি অব্যাহত ছিল, বিশেষ করে রাত্রিকালীন আক্রমণে যখন তারা ছিল অসতর্ক।
অনেকদিন ধরে অবরোধ করেও যখন কোনও ফল পাওয়া গেল না, তখন নবী সা. তাদের অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে রাখার জন্য সতর্ক করলেন, দুর্গের বাইরের আঙুর ক্ষেতগুলি নষ্ট করে দেওয়া হবে (ইবনে হিশাম)। কিন্তু তা করা হয়নি, যেহেতু এতে কোনও বাস্তব উপযোগিতা ছিল না। অবশ্য তায়েফবাসীরা উদ্বিগ্ন হয়ে প্রস্তাব দিয়েছিল যে, সেগুলো নষ্ট না করে যেন গণিমতের মাল হিসাবে গণ্য করা হয়। অন্য ধরনের চাপ সৃষ্টি করার জন্য তিনি ঘোষণা করলেন, যে সমস্ত লোক ইসলাম গ্রহণ করবে এবং মুসলিম বাহিনীর আশ্রয় গ্রহণ করবে তাদের মুক্ত করা হবে (ইবনে সাদ)। অনেকে এই ডাকে সাড়া দিল। দুর্গ অবরোধ প্রসঙ্গে একটা কৌশল অবলম্বন করা হয়েছিল যে, কাঁটাগাছের গোলক বানিয়ে বা ডাল দিয়ে দুর্গের চারিদিকে এমনভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল যেন কেউ খাদ্যসামগ্রী নিয়ে ভিতরে কিংবা রাত্রিকালীন আক্রমণে দুর্গের বাইরে বের হতে না পারে।
চল্লিশ দিন পর নবী সা. অবরোধ তুলে নেন এবং তির, বল্লম দ্বারা মুখোমুখি লড়াই পরিহার করে রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করেন। ফলে কালক্রমে তায়েফবাসীরা ইসলাম গ্রহণ করে।
তায়েফবাসীদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে নবী সা. যে ইয়াহুদি বাগিচায় বিশ্রামের জন্য প্রবেশ করেন এবং যেখানে হযরত জিব্রাইল আ. আগমন করেন, সেই বাগিচা এবং ঘরটি এখনও ইবনে আব্বাস রা. মাযারের ১/২ কি.মি. পশ্চিমে দৃশ্যমান।
বর্তমানে তায়েফ একটি বৃহৎ শহর, পাহাড়ের মালভূমির উপর। এখন সেখানে দুর্গের কোনও চিহ্ন বর্তমান নেই। ইবনে আব্বাসের মসজিদ এবং সংলগ্ন কবরস্থান নবী সা. শিবিরের স্থান নির্দেশ করে। গ্রীষ্মকালীন আবাস হিসাবে এখন মওশুমী ভিড়। ওয়াযী নদী অনেক নীচ দিয়ে প্রবাহিত। দুর্গ পাহাড়ের উপর হলেও গ্রামগুলি ছিল পাহাড়ের নীচে, ক্ষেত-বাড়ি, বাগ-বাগিচা সমৃদ্ধ নদীর সেচ ছিল সুলভ।
ভারতবর্ষে যে আরববাসী মুজাহিদ তাওহিদের দাওয়াত নিয়ে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন হচ্ছেন, মুহাম্মদ বিন কাশিম, যিনি ছিলেন তায়েফের অধিবাসী।