সেখ কুতুবউদ্দিন: ১৮৫৪ সালে আলিয়া মাদ্রাসার অভ্যন্তরে একটি পৃথক গবেষণা ইনস্টিটিউট অ্যাংলো-পার্সিয়ান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিভাগটি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, ভারত ও বাংলাদেশে অবস্থিত বহু মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ অ্যাংলো-পার্সিয়ান বিভাগের সিলেবাস অনুসরণ করতে শুরু করে। এই বিভাগের শিক্ষার্থী থেকে পরবর্তীতে অনেক গুণী ব্যক্তি দিকপাল হয়েছিলেন।
এপি ডিপার্টমেন্টে এ’ন চিত্রটা একেবারে উল্টো। উপযুক্ত পরিকাঠামো আছে। নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক। ছাত্রও দু’টির বেশি নেই। রাজ্য সরকারের তত্ত্বাবধানে থাকা এই বাংলা মাধ্যমের এমনই হাল। তবে এই স্কুলের উর্দু মাধ্যমে শিক্ষক সামান্য কম হলেও ছাত্র রয়েছে ৮০০-এরও বেশি। এ’ন উর্দু মাধ্যম স্কুলে শিক্ষক রয়েছেন ২৮ জন। এর মধ্যে প্রাথমিক স্কুলের ৭ জন।
আগে ক্যালকাটা মাদ্রাসার অধীনে ছিল এপি ডিপার্টমেন্ট। পুরোপুরি রাজ্য সরকারের অধীনে থাকলেও স্কুলটিতে শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্বে রয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন।
এপি ডিপার্টমেন্টে যে বাংলা মাধ্যম রয়েছে, তাতে ছাত্র ২ জন। শিক্ষক সংখ্যাও রয়েছে ২। এতে পঠন-পাঠনের ক্ষেত্রে ‘খুবই অসুবিধা হচ্ছে বলে জানিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। তাই বাংলা বিষয় ছাড়া অন্য বিষয়গুলি উর্দু মাধ্যমেই পড়তে হচ্ছে বাংলা মাধ্যমের পড়ুয়াদের । তিন দশক আগেও এই বাংলা মাধ্যমে ছাত্র সংখ্যার যার পাশাপাশি শিক্ষক অনুপাত কিছুটা বেশি ছিল। সরকারি এই স্কুলের বাংলা মাধ্যমের পড়ুয়ার সংখ্যা এত কম কেন? এই নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন।
স্কুলের অন্যতম শিক্ষক তাজদার আলি মির্জা বলেন, আগে শিক্ষক বেশি ছিল, ছাত্রও ছিল। এ’ন শিক্ষকও কমেছে। ছাত্রও কমেছে। প্রায় বন্ধ হওয়ার মুখে। শিক্ষা দফতরের কাছে বাংলা মাধ্যমের জন্য শিক্ষক চাওয়া হলেও শিক্ষক মেলে না। যে দু’জন ছাত্র রয়েছে, তাদের বাংলা বিষয়টি পড়ানো হয়। শিক্ষক না থাকার জন্য তাদের উর্দু মাধ্যমের ছাত্রদের সঙ্গে ক্লাস করাতে হয়। তিনি বলেন, বর্তমানে এপি ডিপার্টমেন্টে ছাত্র সংখ্যা প্রায় ৮০০ জন। বাংলা মাধ্যমের ৩ জন। বাংলা মাধ্যম, প্রাথমিক এবং উর্দু মাধ্যম মিলে মোট শিক্ষক সংখ্যা ৪৪ জন। এর মধ্যে ১৩ জন বাংলা মাধ্যমের জন্য, উর্দু মাদ্যমের জ্য ২৫ জন। ইংরেজি মাধ্যমে ৬ জন। তবে এ’ন ইংরেজি মাধ্যম শুধু উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ানো হয়। বাংলা মাধ্যমে ২ জন ছাত্রকে ভাষা বিষয় ছাড়া অন্যান্য বিষয়গুলি উর্দু মাধ্যমেই পড়াশোনা করানো হয়। শিক্ষা দফতরের তত্বাবধানে থাকা সরকারি এই স্কুল পরিচালনা হলেও শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্বে রয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন। তাজদার আলি মির্জার দাবি, এই স্কুলে মর্নিং -এ ছাত্রী স্কুল চালু করা হোক। অথবা ইংরেজি মাধ্যম শুরু করা হোক। সেই সঙ্গে বাংলা মাধ্যমে পর্যাপ্ত শিক্ষক দেওয়া হোক। বাংলা ভাষাভাষী ছাত্র সংখ্যা বাড়াতেও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু মাধ্যমের ছাত্র এই এলাকায় পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, স্কুলে পরিকাঠামো রয়েছে। বাংলা ও উর্দু মাধ্যম আলাদাভাবে চালানোর ক্ষেত্রে কোনও অসুবিধা নেই। পাশাপাশি সকালে ইংরেজি মাধ্যমও চালানো যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন। বাংলা মাধ্যমে ছাত্র সংখ্যা যাতে বাড়ানো হয়, তার উদ্যোগও নেয় স্কুল কর্তৃপক্ষ। বাইরে থেকে পড়ুয়ারা পড়তে এলে তাদের থাকার ব্যবস্থা ইলিয়ট হস্টেলে করা হবে বলেও আশ্বাস দেন। তিনি বলেন, ‘আমিও চাই উর্দু মাধ্যমের পাশাপাশি বাংলা মাধ্যমে পর্যাপ্ত শিক্ষক দেওয়া হোক। কারণ বাংলা মাধ্যমে শিক্ষক ও ছাত্র পর্যাপ্ত না থাকার ফলে স্কুলের ঐতিহ্য নষ্ট হচ্ছে।
এপি ডিপার্টমেন্টের উর্দু বিভাগে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত চালু রয়েছে। বাংলা বিভাগেও প্রাক প্রাথমিক থেকে চালু ছিল। পড়ুয়ার অভাবে এ’ন প্রায় বন্ধ। এই স্কুলের সঙ্গে যুক্ত থাকা অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, স্কুলের পরিকাঠামো এ’ন অন্য স্কুলের থেকে ভালো। বিজ্ঞান ও কলা বিভাগ চালু রয়েছে উচ্চ মাধ্যমিকে। বাংলা মিডিয়ামের পাশাপাশি উর্দু মিডিয়াম থাকায় এই স্কুলের আলাদা মাত্রা পেয়ে আসছে।
এপি ডিপার্টমেন্ট স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক শুভ্রজিৎ দত্ত বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদ সামলেছি। স্কুলের বাংলা মাধ্যমের পড়ুয়াদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। তাই বাংলা মাধ্যমের পড়ুয়া বাড়াতে স্কুল কর্তৃপক্ষের প্রচার করা জরুরি। কারণ প্রচারের অভাবে ছাত্রে সংখ্যা কমে যাচ্ছে। জি প্লাস -৫ বিল্ডিংয়ে মোট ৩২টি রুম রয়েছে। এতো ভালো পরিকাঠামো অন্য স্কুলের নেই। তাই স্কুলের কর্তৃপক্ষের এই বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। বাংলা মাধ্যমে শিক্ষকের শূন্যপদ দেখিয়ে আবেদন ও পড়ুয়ার সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
উল্লেখ , ভারতীয় উপমহাদেশের ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে প্রাচীন প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, কলকাতা মাদ্রাসা । যা সকলের কাছে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা নামেই পরিচিত। মাদ্রাসার আরও একটি প্রাতিষ্ঠানিক নাম ছিল কলকাতা মহামেডান কলেজ। ১৭৮০ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস এই মাদ্রাসা বা কলেজের প্রতিষ্ঠা করেন।
আধুনিক ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন ঘটে এই মাদ্রাসার অনুকরণে। এর পর ভারত ও বাংলাদেশে বহু মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০০৭ অনুযায়ী মাদ্রাসাটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করা হয়।
রাজ্য সরকার পরিচালিত শাখাওয়াত মেমোরিয়াল গালর্স স্কুলে উর্দু এবং বাংলা মিডিয়াম চালু রয়েছে বহু দিন থেকে। এই স্কুলের থেকে পড়াশোনা করে উত্তীর্ণ হয়ে অনেকেই দিকপাল হয়েছেন। প্রতিবার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে মেধা তালিকায় থাকেন অনেকে। অন্যদিকে, মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর স্কুলে চালু রয়েছে বাংলা ও উর্দু মাধ্যম।