বিশেষ প্রতিবেদক: বারুইপুর থানা এবং বারুইপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে যে চারজন দরিদ্র ও খেটেখাওয়া সংখ্যালঘু যুবককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, সেই সম্পর্কে বহু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আর এগুলির উত্তর অবশ্যই দিতে হবে বারুইপুর ও মহেশতলা থানার পদাধিকারি, বারুইপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার কর্তৃপক্ষ, বারুইপুর হাসপাতালের সুপার ও চিকিৎসকদের এবং বারুইপুর জেলা পুলিশের সুপারকে।
স্বস্তির খবর হচ্ছে, নবান্নের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে সিআইডি তদন্ত শুরু হয়েছে। তারা সঠিকভাবে তদন্ত করলে হয়তো অনেক কথাই সামনে আসবে। তার থেকেও বড় কথা, কিছু অমানবিক খুনি ও পশ্চিমবাংলায় অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টাকারী ষড়যন্ত্রীদের শাস্তি হবে। বৃহস্পতিবার একটি খবর সামনে এসেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ঝাড়খণ্ডে জেলের মধ্যে এক বন্দি হত্যার অপরাধে ১৫ জনকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে এক আদালত। যখন বন্দিরা জেলে থাকে তখন তারা থাকে জুডিশিয়াল কাস্টোডি বা বিচারবিভাগীয় হেফাজতে। যদি তখন তাদের অবাধে হত্যা করা হয়, তবে বিচারবিভাগ বা আদালতের মর্যাদা বলতে কিছুই থাকে না।
বারুইপুর পুলিশের সবকিছু অস্বীকার করার চেষ্টাঃ
যখন এই মর্মান্তির খবরটি চেপে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা হয় সেইসময় লোক মুখে ও সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি ছড়াতে থাকে। তখন এই ব্যাপারে বারুইপুর ডিস্ট্রিক্ট পুলিশ ‘ফেক নিউজ’ বা ‘ভুয়ো খবর’ শিরোনামে একটি বিবৃতি ইন্টারনেটে ও সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলা ও ইংরেজিতে পোস্ট করে। বাংলা পোস্টটির শিরোনাম হল ‘ভুয়ো খবর’। ‘‘একটি ‘ভুয়ো খবর’ সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে যে বারুইপুর থানার মধ্যে চারজন মুসলিম যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। বারুইপুর থানায় বা পুলিশের হেফাজতে এমন কোনও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। অনুগ্রহ করে এইধরনের ‘ভুয়ো খবর’ ছড়ানো/শেয়ার করা থেকে বিরত থাকুন। যারা এই ‘ভুয়ো খবর’ ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’’ অর্থাৎ বারুইপুর ডিস্ট্রিক্ট পুলিশের এই হুমকিসম্পন্ন পোস্টটির দ্বারা এই হত্যার বিষয়ে যেন কেউ মুখ না খোলে কিংবা কোনও ধরনের সক্রিয়তা না দেখায় তার হুঁশিয়ারি প্রদান করা হয়।
স্বস্তির বিষয়, এখনও কিছু মানবাধিকার কর্মী, সংগঠন এবং সোশ্যাল মিডিয়া রয়েছে, যারা বারুইপুর ডিস্ট্রিক্ট পুলিশের এই ভীতিপ্রদর্শনে থেমে যায়নি। তাঁরা নিহতদের পরিবার-পরিজনকে নিয়ে এসে মিছিল করেন এবং বারুইপুর এসডিওকে স্মারকলিপি প্রদান করেন। এপিডিআর-এর আলতাফ আমেদ পুবের কলম-এর প্রতিনিধি আসিফ রেজাকে বলেন, ‘আমরা এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রকাশ্য প্রতিবাদ এবং স্মারকলিপি প্রদানকে মানবিক কর্তব্য বলে মনে করেছি। অপরাধী পুলিশ ভয় দেখাবে, এটা তো স্বাভাবিক।’
আসলে বারুইপুর ডিস্ট্রিক্ট পুলিশ চার সংখ্যালঘু যুবকের খুনের স্থান নিয়ে ‘শধের খেলা’ খেলতে চেয়েছে। তারা প্রথমে বলেছে, চারজন যুবককে হত্যা করা হয়েছে এই খবরটিই হচ্ছে ‘সম্পূর্ণ ফেক’। বারুইপুর থানায় বা পুলিশের হেফাজতে এমন কোনও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি।
বারুইপুর ডিস্ট্রিক্ট পুলিশের যে কর্তা এই নোটিশটি জারি করেছেন তিনি সম্ভবত বলতে চাইছেন- মৃত্যু তো ঘটেছে জেল হেফাজতে কিংবা বারুইপুর হাসপাতালে। তিনি কিন্তু ভুলে যাচ্ছেন, বারুইপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার এবং বারুইপুর থানা দু’টোই বারুইপুর ডিস্ট্রিক্ট পুলিশের অধীনে। এই দুই ক্ষেত্রে হত্যা হলে তা কিন্তু বারুইপুর পুলিশের এখতিয়ারের মধ্যেই ঘটেছে। এর দায়ও তারা এড়াতে পারেন না। এই ধরনের হত্যা বারুইপুরের যেখানেই ঘটুক, তার তদন্ত বারুইপুর ডিস্ট্রিক্ট পুলিশের উপরই বর্তায়।
আসলে বারুইপুর ডিস্ট্রিক্ট পুলিশ এই বলে নিজেদের আড়াল করার চেষ্টা করছে যে, বারুইপুর থানার মধ্যে তো এই হত্যাকাণ্ডগুলি ঘটেনি। কিন্তু পরিবারের লোকেরা এবং বারুইপুর থানার কর্মচারীদের অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, বারুইপুর থানায় তাদের উপর ব্যাপক অত্যাচার করা হয়েছে। আর তারপর তাদেরকে আহত অবস্থায় জেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। আর বারুইপুর ডিস্ট্রিক্ট পুলিশের আওতায় যে কারাগার রয়েছে, সেখানেও এই চার সংখ্যালঘু যুবকের উপর যে অত্যাচার চলে, তা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। যে ছবি ও ভিডিয়োগুলি রয়েছে তা এত পাশবিক ও বীভৎস যে পুবের কলম তা প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকছে।
এখন প্রশ্ন, কেন বারুইপুর ডিস্ট্রিক্ট পুলিশ যারা নির্দোষ যুবকের হত্যার কথা বলল তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দিচ্ছে, তাও লিখিতভাবে। আর সত্য যে তাদের অজানা ছিল, এমনটা মোটেই নয়। এই ধরনের মৃত্যু বা হত্যার কথা হাসপাতাল বা জেল সবসময় থানাকেই প্রথম অবগত করে। আরও যে ডজন খানেকের বেশি প্রশ্ন রয়েছে তা অবশ্যই আলোচনার দাবি রাখে।