পুবের কলম প্রতিবেদক: দানবীর হাজি মুহাম্মদ মহসিন তাঁর জীবনকালে বহু সমাজসেবা, ধর্মীয় পরিষেবা ও জনকল্যাণের কাজ করেছেন। অবিভক্ত বাংলায় শিক্ষা বিস্তারে তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। সমাজকল্যাণে তিনি অকাতরে বিলিয়েছেন তাঁর ধন-সম্পদ।
আজ ছিল তাঁর প্রদত্ত ফান্ডের টাকায় হুগলি মহসিন কলেজ প্রতিষ্ঠার দিন। আর তাঁর মহসিন ফান্ডের টাকা থেকেই রাজ্যের মাধ্যমিক, হাই মাদ্রাসা ও আলিম পরীক্ষায় সেরা ৯৮ জন সংখ্যালঘু পড়ুয়াকে বিশেষ স্কলারশিপ প্রদান করা হল। প্রতি বছর এজন্য বেছে নেওয়া হয় ১ আগস্ট তারিখকে। এদিনই হুগলি মহসিন কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।
এবারও বিত্ত নিগমের অডিটোরিয়ামে বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কৃতীদের স্কলারশিপ প্রদান করা হল। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী, বিত্ত নিগমের সদস্য, আধিকারিক ও সংখ্যালঘু দফতরের শীর্ষ আধিকারিকরা।
এ দিন অনুষ্ঠানের প্রথমেই বিত্ত নিগম ও দফতরের উন্নয়নমূলক কাজ সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা শিক্ষা দফতরের প্রধান সচিব গুলাম আলি আনসারি। তিনি জানান, প্রতি বছর ১ আগস্ট হাজি মুহাম্মদ মহসিন এনডাওমেন্ট ফান্ড থেকে স্কলারশিপ দেওয়া হয়। অন্যদিকে ঐকশ্রীর মাধ্যমে এ বছর প্রায় ৪০ লাখ পড়ুয়াকে প্রাক-মাধ্যমিক ও মাধ্যমিকোর স্তরের জন্য স্কলারশিপ দেওয়া হয়েছে। আরও কিছু অবেদনপত্র পেন্ডিং রয়েছে, সেগুলিরভেরিফিকেশন পর্ব শেষ হলে টাকা সংশ্লিষ্ট পড়ুয়াদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা করা হবে।
অন্যদিকে বিত্ত নিগমের অন্যতম সদস্য আহমদ হাসান ইমরান শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রে হাজি মুহাম্মদ মহসিনের অবদান তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সিরাজদৌল্লাহর পতনের পর ইংরেজ শাসনে মুসলিমদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। মুসলিমদের বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনের ফলে মুসলিমদের অর্থনৈতিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে সংকট আরও গভীর হয়। হাজি মুহাম্মদ মহসিনের অর্থে মুসলিমদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের কাজ অনেক সহজ হয়। তাঁর টাকাতেই হুগলির মহসিন কলেজ তৈরি হয়েছে। এই কলেজে মুসলিমদের তুলনায় হিন্দু ছাত্রদের সংখ্যাই ছিল বেশি। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মুজাফফর আহমেদ, দ্বীজেন্দ্রলাল রায় প্রভৃতি বিশিষ্টরা এই কলেজে পড়াশোনা করেছেন। শুধু পশ্চিমবাংলায় নয়, অবিভক্ত বাংলায় শিক্ষা বিস্তারে হাজি মুহাম্মদ মহসিনের অবদান অনবদ্য।
হাজি মুহাম্মদ মহসিনের কিছু অর্থ রিজার্ভ ব্যাঙ্কে গচ্ছিত ছিল। কেই বলা হয় মহসিন ফান্ড বা হাজি মুহাম্মদ মহসিন এনডাওমেন্ট ফান্ড। স্বাধীনতার পর বহুদিন এই অর্থ অব্যবহৃত অবস্থায় পড়েছিল। পরবর্তীতে সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্ত নিগম এই ফান্ডের অর্থ থেকেই ২০১১ সাল থেকে প্রতি বছর মাধ্যমিক, হাই মাদ্রাসা ও আলিমে সেরা ছাত্রছাত্রীদের স্কলারশিপ দিচ্ছে। এই উদ্যোগের জন্য ইমরান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে ধন্যবাদ জানান।
তিনি বলেন, রাজ্যের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে ভরসার নাম হয়ে উঠেছে বিত্ত নিগম। এর মাধ্যমে আগামী দিনে আরও ভালো কাজ হবে। এ বছরই সর্বভারতীয় ইংরেজি মাধ্যম বিভিন্ন পরীক্ষা যেমন আইসসি ও সিবিএসই-তে বাংলার মুসলিম ঘরের ছেলেমেয়েরাই সেরার স্থান দখল করেছে। তিনি সংখ্যালঘু মন্ত্রী গোলাম রব্বানিকে অনুরোধ করেন, তাদের যেন বিত্ত নিগম থেকে আলাদা করে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। ইমরান বলেন, হুগলির চূচুড়ার হাজি মুহাম্মদ মহসিনের মাজারটির সংস্কার হওয়া উচিত।
সংখ্যালঘু উন্নয়ন খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য রাজ্য সরকারের প্রশংসা করেন রাজ্যের গ্রন্থাগার দফতরের মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লাহ্ চৌধুরি। তিনি বলেন, রাজ্যে যে সংখ্যালঘু বাজেট রয়েছে দেশের আর কোনও রাজ্যে তা দেখা যায় না। এমনকি কেন্দ্রীয় বাজেট থেকেও এটা বেশি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এগিয়ে যাচ্ছে। আগামী দিনে আরও এগোবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
অন্যদিকে সংখ্যালঘু দফতরের মন্ত্রী মুহাম্মদ গোলাম রব্বানী বলেন, কংগ্রেস আমলে সরকারি চাকরিতে সংখ্যালঘুদের অংশগ্রহণ ছিল ৭ শতাংশ। ৩৪ বছরের বাম শাসনে তা কমে ১-২ শতাংশে নেমে আসে। আমাদের সরকার সংরক্ষণ-বিধি চালু করেছে, বর্তমানে সংখ্যালঘু ঘর থেকেই বড় বড় অফিসার তৈরি হচ্ছে। সমাজ আরও এগোবে। তার জন্য শিক্ষার দিকে বেশি বেশি করে নজর দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, বাম আমলে সংখ্যালঘু খাতে বাজেট বরাদ্দ ছিল মাত্র ৪০০ কোটি টাকা। এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে তা বেড়ে হয়েছে ৫০০৯ কোটি টাকা। কেরিয়ার কাউন্সিলিং ও প্রশিক্ষণের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। বিত্ত নিগম থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকেই সাফল্য পেয়েছে। তিনি বলেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবার উন্নতির জন্যই প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
এ ছাড়াও বেকারদের প্রশিক্ষণ, লোন প্রদান ও অন্যান্য কাজ নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন বিত্ত নিগমের এম.ডি মৃগাঙ্ক বিশ্বাস ও জি.ম মুহাম্মদ নকি।
এ দিনের অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আলিয়ার ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য আবু তাহের কামরুদ্দিন, সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা শিক্ষা দফতরের বিশেষ সচিব সাকিল আহমেদ, সচিব ওবাইদুর রহমান, ডিমই আবিদ হাসান, ওয়াকফ বোর্ডের সিইও আহসান আলি, উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ একেম ফারহাদ প্রমুখ।
এ দিন মধ্যশিক্ষা পর্ষদ থেকে মাধ্যমিকের সেরা ৬৮জন, হাই মাদ্রাসার ২০ ও আলিমের ১০জন মিলিয়ে ৯৮জনকে ২০ হাজার টাকা করে স্কলারশিপ, মানপত্র ও উপহার সামগ্রী তুলে দেওয়া হয়। বিশিষ্টরা এইসব সামগ্রী তুলে দেন।