পুবের কলম প্রতিবেদক: শেষপর্যন্ত কি কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য মানস কুমার সান্যালের বোধদয় হল! তিনি কিছুতেই কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গণিত বিভাগে পিএইচডি-র ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের ঘোষিত সংরক্ষণ নীতি মানতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু মঙ্গলবার কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে। যাতে দেখা যাচ্ছে, পিএইচডি গবেষণায় ওবিসি-এ ও এসসি প্রার্থীদের ২৪ জুন ইন্টারভিউ নেওয়া হবে জানানো হয়েছে। বারবার তাঁর কাছে আবেদন-নিবেদন, ডেপুটেশন দেওয়া হয়। মূলত ওবিসি-এ সংরক্ষণে সংখ্যালঘু মুসলিমরাই শুধু পেয়ে থাকেন। যেহেতু বহু ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া ওবিসি-এ’রা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাচ্ছিলেন, তাই আদার ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস, এসসি-এসটি-র সংরক্ষণ অনুসরণ করে সংখ্যালঘুদের জন্য ওবিসি-এ’র ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য মানস কুমার সান্যালের মতো আরও কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানা কায়দায় ওবিসি-এ ছাত্রছাত্রীদের সংরক্ষণ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছিল। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন-প্রতিবাদ হওয়ায় বহু প্রতিষ্ঠান পুনরায় সংরক্ষণ নীতি কার্যকর করে।
কিন্তু সংরক্ষণ নীতি কার্যকর না করার ক্ষেত্রে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মানস কুমার সান্যাল একবারে অনড় ও অবিচল ছিলেন।
মাস ছয়েকেরও কিছু আগে দেখা গেল, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে এডুকেশন বিভাগে পিএইচডি করার ক্ষেত্রে ওবিসি-এ ২০ জনের মধ্যে একজনকেও নেওয়া হয়নি। এই নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। দৈনিক ‘পুবের কলম’এ বিষয়টি প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মানস কুমার সান্যাল সুন্দর এক কায়দার আশ্রয় নেন। তিনি বলেন, পিএইচডি-র গবেষক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কোনও গাফিলতি হয়েছে কি না, তা দেখার জন্য একটি অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান কমিটি বা রিভিউ কমিটি গঠন করা হচ্ছে। তাঁরা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রিপোর্ট দিলে ওবিসি-এ প্রার্থীদের নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।
কিন্তু আদতে দেখা গেল, শুধুমাত্র সময়ক্ষেপের জন্য এই অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে। কারণ, ছয় মাসের মধ্যেও ওই অনুসন্ধান কমিটি ওবিসি-এ’দের গবেষক হিসেবে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কোনও রিপোর্টই প্রদান করেনি বলে জানিয়েছেন কিছু ওবিসি-এ পড়ুয়া।
কিন্তু এই বঞ্চনাকে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওবিসি-এ ছাত্রছাত্রী, কিছু শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকরা মেনে নেননি। যেমন সারাবাংলা সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের একটি ডেলিগেশন উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করে সংরক্ষণ নীতি কার্যকর করার দাবি জানান। উপাচার্য তাঁদের আশ্বস্ত করেন, ‘আমি তো অনুসন্ধান কমিটি করে দিয়েছি। তাদের রিপোর্ট পেলেই…’। কিন্তু মাননীয় উপাচার্য প্রায় সাত মাস পার হয়ে যাওয়ার পরও ‘নট নড়ন চড়ন’ নীতি অব্যাহত রাখেন।
বেশ কিছু মুসলিম সমাজকর্মী, সচেতন ব্যক্তি ও সংগঠন, শিক্ষা মন্ত্রক-সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি দফতরে এবং মন্ত্রী-সহ দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সবকিছু জানিয়ে চিঠি পাঠাতে থাকেন। উচ্চশিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুও উপাচার্যদের এক বৈঠকে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, সংরক্ষণ নীতি প্রত্যেককেই মেনে চলতে হবে, কাউকে বঞ্চনা করা চলবে না।
যখন কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সংরক্ষণ বিরোধী নীতি উচ্চশিক্ষা দফতরের মন্ত্রী ও সচিবদের গোচরে আসে, তাঁরা ক্ষুব্ধ হন। উচ্চশিক্ষা দফতরের প্রধান সচিব স্পষ্ট করে উপাচার্য মানস কুমার সান্যালকে বলেন, সংরক্ষণ নীতি কার্যকর করা না হলে যে গবেষকদের পিএইচডিতে নেওয়া হয়েছে তাঁদের সিলেকশন বাতিল করে দেওয়ার কথা চিন্তা করা হবে। আরও বলা হয়, অবিলম্বে যোগ্য ওবিসি-এ’দের পিএইচডি-তে সুযোগ দেওয়ার জন্য যেন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
এর আগে কিন্তু উপাচার্য সান্যাল মহাশয়ের কাছে যাঁরা দরবার করতে গিয়েছিলেন, তাঁদের সাফ বলে দিয়েছিলেন, তিনি সংরক্ষণ নীতি মানবেন না। উচ্চশিক্ষা দফতর বললেও তা মেনে চলা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বাধ্যতামূলক নয়।
কিন্তু উচ্চশিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু ও এই দফতরের কঠোর মনোভাব দেখে এবার যেন উপাচার্য সান্যাল মহাশয় একটু নতি স্বীকার করেছেন। মঙ্গলবার কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, তাতে পিএইচডি-তে পাঁচটি সংরক্ষিত আসনের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে, এর মধ্যে ওবিসি-এ’র জন্য সংরক্ষিত রয়েছে ৩টি ও এসসি-র জন্য ২টি আসন। আর ২৪ জুন বেলা ১২টায় এজন্য যোগ্য প্রার্থীদের ‘ওয়াক ইন ইন্টারভিউ’ নেওয়া হবে। যে বিষয়গুলিতে পিএইচডি প্রার্থীদের ইন্টারভিউ হবে সেগুলি হল এনভায়োরনমেন্টাল এডুকেশন, এডুকেশন সাইকোলজি, টিচিং স্ট্রাটেজিস।
ওয়াকিফহাল মহল বলছেন, অনড় উপাচার্যকে পথে আনতে ব্রাত্য বসুর নেতৃত্বাধীন উচ্চশিক্ষা মন্ত্রক বড় ভূমিকা পালন করেছে। সংখ্যালঘু ও এসসি, এসটিদের সংরক্ষণ বিরোধী মানস কুমার সান্যাল শেষপর্যন্ত খানিকটা হলেও পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন। আর সচেতনতা সৃষ্টিতে দৈনিক ‘পুবের কলম’ ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।