স্বামীর দ্বারা নৃশংসভাবে হাতের কবজি হারিয়েও কঠিন লড়াই করে ফিরে আসা সংগ্রামের প্রতীক কেতুগ্রামের রেণু খাতুন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। তাঁর দৃঢ়তা এবং অসীম মনোবল সারা দেশে অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। নজর কেড়েছে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও। পুবের কলম থেকে তাঁর একটি এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য রেণু খাতুনের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলেন সাংবাদিক এস জে আব্বাস ।
রেণু খাতুন জানালেন, তিনি এখন অনেকটাই ভাল আছেন। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। তবে যন্ত্রণা এখনও রয়েছে।
নিকটজনের হাতে আক্রান্ত হয়ে আপনি মনোবল হারাননি । বরং এক চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে এসেছেন । আর সমাজ আপনার লড়াইকে স্বীকৃতি দিয়েছে । এ সম্পর্কে কিছু বলুন ।
রেণু বললেন, সত্যিই তাই। ঘটনার দিনও আর পাঁচটা রাতের মতো যখন আমরা একসঙ্গে ঘুমাতে গেলাম, তখনও ভাবতে পারিনি এমন বিভীষিকাময় রাত অপেক্ষা করছে আমার জন্য। মধ্যরাত যখন, আচমকা বুঝতে পারলাম আমার মুখে একজন বালিশ চেপে ধরে আছে, একজন শক্ত করে পা ধরে আছে। আর কেউ একজন শক্ত ধারালো কিছু দিয়ে আমার হাতের কবজি কেটে নিচ্ছে। যন্ত্রণায় ছটফট করছিলাম। রক্তে বিছানা ভেসে যাচ্ছিল। ভাবতে পারিনি যে আমি এভাবে প্রাণ নিয়ে বেঁচে ফিরতে পারব। আজ নতুন জীবন ফিরে পেয়েছি। কৃতজ্ঞতা জানাই মহান আল্লাহর কাছে। প্রশ্নের উত্তরে রেণু জানালেন, তাঁদের বিবাহিত জীবনের কথা। বললেন, বিয়ের পর আমি আনন্দেই ছিলাম । শ্বশুর বাড়ির লোকেরাই আমাকে পড়তে সহযোগিতা করেছিল । বেশ সুখে শান্তিতেই ছিলাম । তারপর হঠাৎ এই অবস্থা… (গলা ধরে এল)
রেণু খাতুনকে প্রশ্ন করা হয়, আপনি একটা লড়াই জিতে ফের জীবন সংগ্রামে অংশ নিচ্ছেন । বলতে গেলে আপনি বাংলা তথা ভারতের নিপীড়িত নারী-সমাজের কাছে উহাদরণ, অনুপ্রেরণা । রাজ্য মহিলা কমিশনও আপনার সঙ্গে কথা বলেছে, সমগ্র বিষয়ে আপনি কি বলবেন ?
রেণু বললেন, হ্যাঁ, কমিশনও আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমাকে ভরসা জুগিয়েছে। আমি এটুকুই বলব, দেশের কোনও প্রান্তে নারীরা যেন এমন নৃশংস ঘটনার শিকার না হয়, তার জন্য সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
ইসলামের দৃষ্টিতে নারীদের শিক্ষা ও স্বনির্ভরতা সম্পর্কে কি কোন বাধা আছে?
এই প্রশ্নের জবাবে রেণু বললেন, আমি মাদ্রাসায় পড়া একজন ছাত্রী। চিনিসপুর হাই মাদ্রাসা থেকে মাধ্যমিক পাস করেছি। সেখানে পড়তে পড়তে ইসলামের যে শিক্ষা সম্পর্কে জেনেছি তাহল, আমাদের নবী সা. নারী-পুরুষের শিক্ষাকে খুবই গুরুত্ব দিতেন, তাছাড়া ইসলামে নারীদের ব্যাপক সম্মান এবং স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে, নারীদের স্বাধীনভাবে ব্যবসা ও অর্থনৈতিক কাজকর্মেরও অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
ইসলামের আদেশ হচ্ছে রোগীকে দেখতে যাওয়া ও তার পাশে থেকে তাকে আশ্বস্ত করা জান্নাতের বার্তা দেয়। আর অসুস্থ রোগীর সেবা করাতে আল্লাহ্ বিশেষ পছন্দ করেন। আপনার সঙ্গে যে ঘটনা ঘটল এবং তার সঙ্গে ইসলামী শিক্ষায় যে বৈপরিত্য সেই সম্পর্কে কি বলবেন?
উত্তরে রেণু স্পষ্ট জবাব দিলেন, অবশ্যই মানব সেবার উপর কিছুই নেই। ইসলামও মানব সেবার জন্য, শুধু মানব সেবা নয়, যে কোনও প্রাণীর প্রতি দয়া প্রদর্শনের নির্দেশ আছে। একটি বিড়ালকে না খেতে দিয়ে মেরে ফেলায় একজন ধর্মপ্রাণ নামাযি মহিলার জন্য হাদীসে জাহান্নামের শাস্তি শোনানো হয়েছে। বিবেকানন্দের বাণী, ‘জীবে প্রেম করে যেই জন/সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।’ আমারও ইচ্ছে ছিল যন্ত্রণাক্লিষ্ট, অসুস্থ-অসহায় রোগীদের সেবা করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা। এর মধ্যেই আমি আনন্দ খুঁজেছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার সেই মূল্যবান ডান হাতের কব্জী কেটে দেওয়া হয়েছে। হ্যাঁ, তবে অসংখ্য মানুষের অনুপ্রেরণা আর ভালোবাসা আছে। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীও আমাকে হাসপাতালেই অন্য ধরণের কাজ দেবেন বলেছেন। আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর তুলনা হয় না। তিনি যেভাবে সমাজের প্রতিটা দিকে নজর দেন, তা এককথায় অকল্পনীয়। কন্যাশ্রী প্রকল্পের মাধ্যমে সত্যিই আজ মেয়েরা শিক্ষা-দীক্ষায় ছেলেদের সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিয়ে এগোচ্ছে। আসলে মুখ্যমন্ত্রী হলেন আমাদের অনুপ্রেরণা। তাঁকে শত কোটি সালাম।
আপনাদের বিয়ের পর আপনি পড়াশোনা ও নার্সিং ট্রেনিং করেছিলেন । সেখানে কী আপনার শ্বশুরবাড়ি থেকে বাধা এসেছিল ?
প্রশ্নের উত্তরে রেণু বললেন, বিয়ের আগেই কলকাতার আরজি কর হাসপাতালে নার্সিংয়ের ট্রেনিং-এ ভর্তি হই । শ্বশুরবাড়ির লোকজনেরাই তখন আমাকে নার্সিং ট্রেনিংয়ে উৎসাহ এবং সহযোগিতা করেন । সে সময় তাঁদের কোনও আপত্তি ছিল না।
রেণুকে বলেছিলাম, আপনার উপর নৃশংস ঘটনার জন্য অনেক অভিভাবকই বিচলিত। তাঁদের জন্য কী বলবেন?
রেণু জোর দিয়ে বললেন, অভিভাবকদের একটাই কথা বলব, ছেলে হোক বা মেয়ে, কখনও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। কারণ, এই প্রশ্রয় পেতে পেতে একদিন ওরাই সমাজের জন্য বড় বিপদ ডেকে আনবে।
আপনি তো বলছেন অন্ধ ভালোবাসা বা আপনাকে হারানোর ভয়ে স্বাভাবিক জ্ঞান হারিয়ে এই নৃশংস ঘটনা ঘটিয়েছে আপনার স্বামী । এটা কি ঠিক?
রেণুর বক্তব্য, আসলে আশপাশের লোকজন বা বন্ধুবান্ধব তাকে আমার সম্পর্কে ভুল ভাবাতে শুরু করে। সে ভাবতে থাকে আমি চাকরি করলে হয়ত আর ওর কাছে থাকব না। সমাজ এখনও নারীদের স্বনির্ভর হওয়াটাকে পুরোপুরি মেনে নেওয়ার মতো অবস্থায় নেই। এই দেখুন না, এই ক’দিনের মধ্যেই আবারও এমন এক নৃশংস ঘটনার খবর শুনলাম।
শেষে রেণুতে জিজ্ঞাসা করলাম, এখন কি তিনি কিছু কাজকার্ম করতে পারছেন?
রেণু জানালেন, আসলে আশপাশের মানুষের যে ভালোবাসা, সহযোগিতা আর উৎসাহ আমি পেয়েছি, তাতে আমি আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী। আমি এখন বাঁ হাত দিয়ে বাংলা, ইংরেজি লিখতে পারি। ব্রাশ করা, নিজে নিজে খাওয়া, পোশাক পরা এমন অনেক কিছুই করতে পারছি।
রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ তথা পুবের কলম পত্রিকার সম্পাদক আহমদ হাসান ইমরানের সঙ্গে প্রতিবেদক মারফৎ মোবাইলে কথা বলতে পেরে রেণু খাতুন ভীষণই খুশি এবং অনুপ্রাণিত।
ইমরান সাহেব তাঁকে উৎসাহ জোগাতে পড়ার জন্য উপহার হিসাবে একটি বাংলায় অনুদিত কুরআন এবং নবী সা.-র জীবন ও শিক্ষার উপর লেখা কলম-এর একটি সংকলন প্রতিবেদকের হাতেই পাঠিয়েছিলেন। রেণু এগুলি পেয়ে খুবই খুশি। বললেন, ‘অবশ্যই এগুলি আমি পড়ব। আরও জানিয়েছেন, এভাবেই বড়দের দোয়া ও আশীর্বাদ আমার চলার পথে শক্তি জোগাবে।’