পুবের কলম, ওয়েবডেস্ক: চারিদিকে শুধু হাহাকার! এই আর্ত চিৎকার জলের! আজ যেখানে হাহাকার একদিন সেখানেই ছিল টলমলে জল। এক সময়ে মধ্য চিলির পেনুলাস জলাধারটি ভালপারাইসো শহরের জলের প্রধান উৎস বিবেচিত হত। যেখানে ৩৮ হাজার অলিম্পিক-আকারের সুইমিং পুলের জন্য যথেষ্ট জল রাখার ক্ষমতা ছিল। বিগত ২০ বছর আগের সেই দিন আর নেই। এখন শুধু দুটি জলাধার টিকে আছে। চারিদিকে শুধু ফাটলধরা মাটি। জল খুঁজতে আসা প্রাণীর কঙ্কাল পড়ে থাকে শুকনো জলাধারের উপরে।
চিলি দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের একটি দেশ। দেশটি প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল ঘেঁষে প্রসারিত একটি ভূখণ্ড। উত্তর-দক্ষিণে চিলির দৈর্ঘ্য প্রায় ৪,২৭০ কিলোমিটার, কিন্তু এর গড় বিস্তার ১৮০ কিলোমিটারেরও কম। উত্তরের মরুভূমি থেকে শুরু করে দক্ষিণে রয়েছে ঝঞ্ঝাপীড়িত হিমবাহ ও ফিয়র্ড। দেশটির মধ্যভাগে একটি উর্বর উপত্যকা অবস্থিত। পূর্বে আন্দিজ পর্বতমালা আর্জেন্টিনার সঙ্গে সীমান্ত তৈরি করেছে। চিলির রাজধানী ও বৃহত্তম শহর সান্তিয়াগো মধ্যভাগের উপত্যকায় অবস্থিত।
কিন্তু এই সুন্দর বৈচিত্র্যের পিছনে রয়েছে এক আর্তনাদ, হাহাকারের কাহিনি। এখন সেখানে শুধুই খরা। কারণ জলাধারগুলি শুধুই শুকিয়ে যাচ্ছে। ১৩ বছরের এই খরার নেপথ্যে ভিলেনের ভূমিকায় রয়েছে বৃষ্টির অপ্রুতলতা। দক্ষিণ আমেরিকার দেশটিতে বৃষ্টিপাতের মাত্রা কমে গেছে। দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম সীমান্ত, সমগ্র সীমান্ত জুড়ে প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে সুদীর্ঘ আন্দিজ পর্বতমালা।
এই খরা বিশ্বের বৃহত্তম তামা উৎপাদক খনি উৎপাদনে আঘাত হেনেছে, লিথিয়াম ও কৃষিকাজের জন্য জলের ব্যবহার নিয়ে সংশয় তৈরি করেছে।
৫৪ বছর বয়সী স্থানীয় বাসিন্দা আমান্দা ক্যারাস্কো’র মুখে শোনা গেল হাহাকারের করুণ কান্না। আমান্দা ক্যারাস্কো’ বলছেন, ‘আমরা জলের জন্য ঈশ্বরের কাছে ভিক্ষা চাইছি। এক সময় এই জলাধারেই মাছ ধরতেন তিনি। এই অবস্থায় কান্না ভেজা গলায় আমান্দা’ বলেন, আমি কোনদিন এই রকম অবস্থা দেখেনি। জল আসতে আসতে কমতে শুরু করেছে, তবে আজকের মতো অবস্থা হবে ভাবিনি।
এসভাল(ভালপারাইসো)-এর জেনারেল ম্যানেজার লুইস মুরলিও জানিয়েছেন, জলাধার ভরাতে বৃষ্টিপাতের প্রয়োজন। আমাদের এখন আছে বলতে একটি জলাশয়। মূলত এখন আমরা নদীর ওপরে নির্ভরশীল। মধ্য চিলির পেনুলাস জলাধারটি ভালপারাইসো শহরের জলের প্রধান উৎস বলে বিবেচিত হত। এখন সবই ইতিহাস।
আর দুঃখের পিছনে গবেষণায় উঠে আসা একটি কারণ ব্যাখ্যা করে দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তন। প্রশান্ত মহাসাগরের উপরে তৈরি ঘনীভূত নিম্নচাপ চিলির উপরে বৃষ্টিপাত ঘটায়। আন্দিজ পর্বতমালা বরফে ঢেকে যায়। যেমন তুষার আবৃত চূড়া কোটোপেক্সির কয়েক কিলোমিটার পরেই রয়েছে সবুজে আবৃত রেইনফরেস্ট। পুরো দক্ষিণ আমেরিকা জুড়ে বিস্তৃত হওয়ার কারণে এর বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন জলবায়ু পরিলক্ষিত হয়। মহাদেশীয় জলবায়ুর উপর ভিত্তি করে আন্দিজ পর্বতমালাকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে। গ্রীষ্মপ্রধান বা ক্রান্তীয় আন্দিজ, শুষ্ক আন্দিজ এবং আর্দ্র আন্দিজ। দক্ষিণ আন্দিজের জলবায়ু ঠাণ্ডা এবং বৃষ্টিবহুল। আবার মধ্য আন্দিজের জলবায়ু শুষ্ক। উত্তর আন্দিজের জলবায়ু বৃষ্টিবহুল এবং উষ্ণ। এছাড়া আন্দিজের দক্ষিণে অর্থাৎ চিলি ও আর্জেন্টিনা সীমান্তে আছে ক্রান্তীয় হিমবাহ অঞ্চল, যা বিশ্বের প্রায় ৯৫ শতাংশ ক্রান্তীয় হিমবাহের মজুদ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে এই হিমবাহের বরফ এখন দ্রুত গলে যাচ্ছে। অন্যদিকে রয়েছে আন্টার্টিক আবহাওয়া। অ্যান্টার্কটিকায় ওজোন হ্রাস এবং গ্রিনহাউস গ্যাসের কারণে চিলি থেকে ঝড়কে ক্রমশ দূরে সরছে।
চিলির সেন্টার ফর ক্লাইমেট অ্যান্ড রেজিলিয়েন্সের গবেষক ডানকান ক্রিস্টি বলেন, ৪০০ বছর আগের গাছের গায়ে থাকা দাগ বিশ্লেষণ করে বলেন, যে বর্তমান খরা কতটা বিরল। তিনি বলেছিলেন যে আন্দিজ যাকে তিনি দেশের “জলের টাওয়ার” বলে অভিহিত করেছেন, পুনরায় পূরণ করার সুযোগ পাচ্ছে না। যার ফলস্বরূপ বসন্তে বরফ গলে যাওয়ায় নদী, জলাধার এবং জলাশয়গুলি পূরণ করার জন্য অনেক কম জল ছিল।
সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এবং জল বিশেষজ্ঞ, মিগুয়েল লাগোস, সান্তিয়াগো থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার (৩১ মাইল) পূর্বে কেন্দ্রীয় চিলির লেগুনা নেগ্রা স্টেশনের কাছে তুষার আচ্ছাদন পরিমাপ করার ভ্রমণও করেন।
ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ ক্লাইমাটোলজিতে ২০১৯ সালের একটি সমীক্ষা যা ২০১০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে চিলির খরা বিশ্লেষণ করে বলেছে যে আবহাওয়ার ঘটনাগুলি পরিবর্তন এই খরার অন্যতম কারণ। তবে জলবায়ুর এই পরিবর্তন মানুষের জীবন যাত্রার উপর প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ একদিকে যেমন রয়েছে কম বৃষ্টিপাতের মতো ঘটনা এবং অন্যদিকে উষ্ণ পরিস্থিতি হচ্ছে যে শীতেও বরফ গলে যাচ্ছে। যেহেতু তুষার জমে একটি স্তর তৈরি করে, সেটি আবহাওয়াকে ঠাণ্ডা রাখতে সাহায্য করে। এখন সেটি হচ্ছে না।
লাগোস বলেন, কম তুষারপাতের সঙ্গে উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে তুষারের স্তরগুলি দ্রুত গলছে, বা সরাসরি বাষ্পে পরিণত হচ্ছে।
এই প্রক্রিয়াকে বলা হচ্ছে সাবমিলিয়েশন।
চিলির গ্রামের একজন পশু প্রজননকারী ঈশ্বরের দুয়ারে প্রার্থনা করছেন যে পরিবর্তন শীঘ্রই আসবে। এবছর বৃষ্টি না হলে কি হবে জানি না, পশুপাখিরা আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।
কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত চাষিরা এই অবস্থাকে তাদের জীবনের দুর্ভাগ্য বলে উল্লেখ করেছেন।
চিলি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মতে আগামী ৩০ বছরে আরও ৩০ শতাংশ কমবে জল সরবরাহ। গাণিতিক হিসাব ও ঐতিহাসিক গবেষনার মাধ্যমেই তারা এই তথ্য তুলে ধরছেন।
সান্তিয়াগোর দক্ষিণে আরেকটি শুকিয়ে যাওয়া হ্রদ লেগুনা দে আকুলিওতে জল ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় ক্যাম্পসাইট ম্যানেজার ফ্রান্সিসকো মার্টিনেজ শত শত লোককে কায়াক বের করতে বা জলে সাঁতার কাটার কথা স্মরণ করে গভীর অনুশোচনা করেন। এখন সেই নৌকাগুলি একদিনে পড়ে থাকে। এখন এই দ্বীপ প্রায় ধুলোয় ঢেকে গেছে।
মার্টিনেজ রয়টার্সকে দেওয়া এক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, জলাধার এখন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। পশুপাখিরা প্রাণ হারাচ্ছে। আমরা আর আমাদের সেই হ্রদকে খুঁজে পাব না।