গোলাম রাশিদ : চলে গেলেন চতুরঙ্গ পত্রিকার সম্পাদক আবদুর রাউফ। বৃহস্পতিবার সন্ধে ৭.৪৫ মিনিটে পার্ক সার্কাসের ৭ নম্বর মেহের আলি রোডের ফ্ল্যাটে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আতাউর রহমান ও হুমায়ুন কবিরের ঐতিহ্য বজায় রেখে তিনি চতুরঙ্গ পত্রিকাকে এক বিশিষ্ট জার্নালে পরিণত করেছিলেন।
সেইসঙ্গে যুক্তি ও বোধের সমন্বয়ে প্রবন্ধচর্চাকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন ভিন্ন এক স্তরে। সম্মানের সঙ্গে তাঁর নাম বাংলার সুধীমহলে উচ্চারিত হবে। দীর্ঘ ২৬ বছর হুমায়ুন কবীর ও আতাউর রহমান প্রতিষ্ঠিত ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন তিনি। এই সময়কালে তিনি পত্রিকাটিকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। এক সময় আবদুর রাউফ ও চতুরঙ্গের নাম বিদগ্ধ মহলে একসঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে। পরবর্তীতে সংবাদ প্রতিদিন পত্রিকায় তিনি কিছুদিন নিয়মিত সাপ্তাহিক কলাম লিখেছেন। আর এই কলামে তিনি বহু অন্যায়ের মুখোশ খুলে দিয়েছেন। মিথ্যা অপপ্রচারের অপনোদন করেছেন। বলেছেন, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলির জন্য ইনসাফের কথা।
আবদুর রাউফের ইন্তেকালের খবর ছড়িয়ে পড়তেই বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। গুণমুগ্ধ মানুষরা তাঁর বাড়িতে ভিড় করেন। আবদুর রাউফের পুত্র আসাদ রউফ নেদারল্যান্ডসে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। তিনি পিতার মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর সেখান থেকে কলকাতার উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। এসে পৌঁছবেন শনিবার। তাঁর মা (আবদুর রাউফের সহধর্মিনী মুসতাবসেরা রাউফ) জানান, রবিবার জনাব আবদুর রাউফের জানাযা ও দাফন হবে বলে আপাতত স্থির রয়েছে। দাফন হবে কলকাতার গোবরা কবরস্থানে। দাফনের আগে তাঁর লাশ কলকাতার পিস হেভেনে রাখা হবে।
গত এপ্রিল মাস থেকে তিনি অসুস্থ ছিলেন। ধীরে ধীরে শরীর অসাড় হয়ে পড়েছিল। কাউকে চিনতে পারতেন না। শেষ স্টেজের ক্যানসার ধরা পড়েছিল। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ ও তত্ত্বাবধানে বাড়িতে রেখেই তাঁর চিকিৎসা চলছিল। স্ত্রী মুসতাবসেরা রাউফ জানান, কয়েকদিন থেকে পেটে জল জমছিল। চিকিৎসায় কোনও রকম সাড়া দিচ্ছিলেন না তিনি। এর আগের বছর তিনি কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছিলেন। তবে করোনাকে হারিয়ে জীবনে ফিরে এসেছিলেন। এবার ক্যানসারের কাছে হার মানলেন চতুরঙ্গের রাজা। ৭৬ বছর বয়সে পাড়ি জমালেন অন্য ভুবনের উদ্দেশে।
স্বাধীনতার কয়েক মাস আগে ১৯৪৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি হুগলির গয়েশপুরে তাঁর জন্ম। স্থানীয় তারকেশ্বর হাইস্কুলে পড়াশোনার পর ভর্তি হন কলকাতার মাওলানা আজাদ কলেজে। কলেজে পড়াকালীনই বৌদ্ধিক জগতের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটতে থাকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে এমএ পড়ার সময় থেকে তিনি লেখালেখি শুরু করেন। পরবর্তীতে আনন্দবাজার পত্রিকা, দৈনিক বসুমতী, যুগান্তর, আজকাল, সংবাদ প্রতিদিন, পুবের কলম-সহ বহু পত্রিকায় মননশীল নিবন্ধ লিখেছেন। চতুরঙ্গ ছাড়াও ‘আল হিলাল’ নামে একটি পাক্ষিক ও ‘যুব সংস্কৃতি’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। সংবাদ প্রতিদিনে তাঁর নিয়মিত কলাম ‘দৃষ্টিপাত’ সাহিত্যসমাজমনস্ক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। বহুমাত্রিক নজরুল, স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান, মুক্তমনের সংকট, ভারতের বাংলাভাষী মুসলমান, গণতন্ত্র ও সংখ্যালঘু সমস্যা প্রভৃতি গ্রন্থে তাঁর শাণিত যুক্তির উপস্থাপনা দেখা গিয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিকাশে অনবদ্য অবদানের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয় সংহতি পরিষদ তাঁকে সম্মানিত করেছিল। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির লিটল ম্যাগাজিন মেলায় সেরা সম্পাদক হিসেবে পুরস্কারের পাশাপাশি পেয়েছেন নতুন গতি সাহিত্য পুরস্কার। বাংলার মিশনারি শিক্ষা আন্দোলনের পাশে থেকেছেন, সংযুক্ত ছিলেন জনাব মোস্তাক হোসেনের জি ডি-র শিক্ষা ও উদ্যোগের সঙ্গে। সরকারি-বেসরকারি বৌদ্ধিক সভায় তাঁর উপস্থিতি ও মেধাবী বক্তৃতা আলাদা করে নজর কেড়েছে সুধীজনের। স্বাধীনতার পর এপার বাংলায় হাতে গোনা কয়েকজন প্রাবন্ধিক বৃহত্তর সমাজের কাছে নিজেদের শাণিত মেধা ও প্রজ্ঞাকে তুলে ধরতে পেরেছিল। আবদুর রাউফ ছিলেন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য।
তাঁর ইন্তেকালে পুবের কলম পত্রিকার সম্পাদক আহমদ হাসান ইমরান গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। শোকবার্তায় তিনি বলেন, আবদুল রাউফের ইন্তেকালে একটি ইতিহাস এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের একজন শ্রেষ্ঠ লেখক ও সাহসী যোদ্ধাকে আমরা হারালাম। আমি আল্লাহ্র কাছে তাঁর জান্নাত প্রার্থনা করি। প্রার্থনা করি আল্লাহ্ যেন তাঁর পরিবারকে সব্র প্রদান করেন।