আসাদুল ইসলাম: ইচ্ছেশক্তি প্রবল হলে পাহাড়সম বাধা যে টপকানো যায়, তা আরও একবার প্রমাণ করল সাহিল সরকার। বিশেষভাবে সক্ষম সাহিল মুখ দিয়ে লিখে পড়াশোনা চালিয়ে এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রায় ৯২ শতাংশ নম্বর পেয়েছে। ডানহাত নেই। বাম হাতের নেই তিনটে আঙুল। এমন শারীরিক অসুবিধাকে অগ্রাহ্য করেই সাহিল অনেক সুস্থ-স্বাভাবিক ছাত্রছাত্রীর চেয়ে ভালো ফল করে নজির তৈরি করল।
মালদা জেলার চাঁচল থানার চাঁচল গ্রামে বাড়ি সম্পন্ন ব্যবসায়ী আমিরুল ইসলাম ও গৃহবধূ সাবিনা ইয়াসমিনের। এই দম্পতির এক মেয়ের পর কোল আলো করে সুস্থ-সবল পুত্রসন্তান সাহিল জন্ম নেওয়ার পর যে খুশির আলো ছড়িয়ে পড়েছিল সংসারে, তা হঠাৎ করেই অন্ধকারে বদলে যায়। সাহিলের যখন বছর সাতেক বয়স তখন ১১ হাজার ভোল্টের তারে তড়িদাহত হয়। প্রথমে মালদা হাসপাতালে তারপর কলকাতার এক নামি নার্সিংহোমে চিকিৎসা চলে। কয়েক মাস যমে-মানুষে টানাটানির পর প্রিয় সন্তান ঘরে ফেরে। কিন্তু ডানহাত কেটে বাদ দিতে হয়। বাদ যায় বাম হাতের তিনটে আঙুল। তারপর শুরু হয় লড়াই।
মা-বাবা আর সন্তান— তিনজনের লড়াইয়ে বাধা কাটতে শুরু করে। এক বছর স্কুল থেকে বাইরে থাকার পর পড়ালেখা শুরু হয় সাহিলের। কান্নায় ভেঙে পড়ে হেরে যায়নি শক্ত মনের সাহিল। ধীরে ধীরে নিজে থেকে প্রচেষ্টা চালিয়ে মুখ দিয়ে লেখা আরম্ভ করে। বন্ধুদের সঙ্গে পাশাপাশি বসে ক্লাস করে, নোট নিজে লিখে মেধার পরিচর্যার খামতি না এগিয়ে চলে বন্ধুদের পিছনে ফেলে। হয়ে ওঠে মেধাবী। শিক্ষাপ্রিয় স্নাতক বাবা ও মাধ্যমিক পাশ মা ছেলের উৎসাহ দেখে পড়াশোনা শেখানোর প্রচেষ্টায় থামতি রাখেননি। আল-আমীন মিশনে সাহিলের দিদিকে ভর্তি করেছিলেন তাঁরা। সাহিলকেও সমান সুযোগ দিয়ে, মিশনে ভর্তি করে বুঝিয়ে দেন তুমি কোনও অংশে কম নও। আল-আমীন মিশনের দক্ষিণ দিনাজপুরের বেলপুকুর শাখায় ক্লাস সেভেন থেকে পড়েছে সাহিল। এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসেছিল। মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো হতে যাতে বাধা না হয় তার জন্য মিশনের ব্যবস্থাপনায় রাইটার নিয়ে পরীক্ষা দিয়েছিল।
পেয়েছে ৯১.৮৬ শতাংশ নম্বর। ভূগোলে ১০০, অঙ্কে ৯৯, জীবনবিজ্ঞানে ৯৭, ইংরেজিতে ৯১, ভৌতবিজ্ঞানে ৮৬, ইতিহাসে ৮৬ এবং বাংলায় ৮৪ নম্বর পেয়েছে। বর্তমানে আল-আমীন মিশনের হাওড়ার খলিসানি শাখায় একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করছে। ভবিষ্যতে সে আইওএস হতে চায়। উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফল করার পর আইআইটি।
তারপর ইউপিএসসি। সুচিন্তিত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সাহিলের। আল-আমীনের বহু ছেলেমেয়ের মতো তার দিদি মিশন থেকে পড়ে ডাক্তার হওয়ার জন্য নিট পরীক্ষার প্রস্তুতির প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। সাহিল সে পথে হাঁটতে চায় না। সে হতে চায় দক্ষ প্রশাসক। আর সেটা যে সম্ভব, তা মনে করেন আল-আমীন মিশনের সাধারণ সম্পাদক এম নুরুল ইসলামও। ‘সাহিলের মনের জোর অসম্ভব। পরিশ্রমীও। ও নিজের স্বপ্ন পূরণ করে আমাদের সকলের কাছে একদিন প্রেরণার উৎস হয়ে উঠবে, জানান তিনি। ৭৫ শতাংশ প্রতিবন্ধকতাকে হার মানিয়ে যে ছেলে ৯২ শতাংশ নম্বর পায়, সে তো এখনই অনুপ্রেরণার মুখ!