সাকিল আহমেদ,পাথরপ্রতিমা: ‘একদিন এই দেহখানি মাটি হবে, দুনিয়ার যা কিছু সব পড়ে রবে’। পাড়ার মিলাদে এই গজল শুনেছিলেন আশরাফ। সেই গজল যে বদলে দেবে তার নিজের জীবনের ভাবনা, তা কী আর জানতেন তিনি! দেশে যখন উগ্রবাদীরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে, মুসলমানদের প্রাচীন মসজিদগুলি কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত হচ্ছে, তখন মৃত্যু পথযাত্রী এক হিন্দু বন্ধুর জীবন বাঁচাতে অবলীলায় আশরাফ দান করে দিলেন নিজের একটা কিডনি। তাঁর এই মহৎ দানে কার্যত নতুন জীবন পেলেন কানাইলাল সাহু। বছর ৫৭-র আশরাফ আলি স্বেচ্ছায় নিজের একটি কিডনি দান করে জীবন বাঁচালেন বছর ৩৫-এর কানাইলাল সাহুর।
আরেকবার ভারতের সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার শাশ্বত ছবিটির সাক্ষী থাকল দেশ। দক্ষিণ ২৪ পরগনার পাথরপ্রতিমা ব্লকের রামগঙ্গার বাসিন্দা কানাইলাল দীর্ঘদিন ধরে রোগে ভুগছিলেন। অনেক পরীক্ষার পর চিকিৎসকরা জানান, তাঁর দু’টি কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে। শীঘ্রই তাঁর একটি কিডনির প্রয়োজন। কিন্তু কোথায় পাবেন কিডনি? এই ভাবনায় ঘুম উড়ে গিয়েছিল সাহু পরিবারের। তেমন সামর্থ্যও পরিবারের নেই যে তা অর্থের বিনিময়ে পাবেন। তাই বাঁচার আশাই একরকম ছেড়ে দিয়েছিল কানাইলালের পরিবার। কানাইলাল নিজেও সেজন্য সবসময় মনমরা হয়ে থাকতেন। মৃত্যুভয় যেন ক্রমেই গ্রাস করছিল তাঁকে। এমন এক কঠিন সময়ে কানাইলাল ও তাঁর পরিবারের পাশে এসে দাঁড়ালেন পাথরপ্রতিমা ব্লকেরই এল-প্লটের উপেন্দ্রনগরের বাসিন্দা সেখ আশরাফ আলি।
একদিন কলকাতা থেকে ডাক্তার দেখিয়ে আত্মীয়ের সঙ্গে বাড়ি ফিরছিলেন কানাইলাল। ফেরার পথে বাসেই তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় আশরাফের। একই ব্লকের বাসিন্দা হওয়ায় ক্রমে দু’জনের মধ্যে গড়ে ওঠে বন্ধুত্বের সম্পর্কও। দুই পরিবারের মধ্যেও তৈরি হয় সুসম্পর্ক। নানা কথাবার্তার মাঝে আশরাফ একদিন জানতে পারেন বন্ধু কানাইলাল কিডনির অসুখে ভুগছেন। শীঘ্রই একটি কিডনি প্রতিস্থাপন করতে না পারলে বন্ধুর জীবনমরণ সমস্যা হতে পারে। অনেক ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নেন আশরাফ। একটা দিলে একটা তো থাকবে। অন্যদিকে, বেঁচে যাবে আর একটা পরিবার। কয়েকদিন আগে বন্ধু কানাইলাল ও তাঁর পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে আশরাফ চলে আসেন কলকাতায়।
ইএম বাইপাসের ধারে ডাক্তার দেবী শেঠীর হাসপাতালে নিজের একটি কিডনি কানাইলালকে দান করেন। সম্প্রতি চিকিৎসকরা সম্পূর্ণ সফলতার সঙ্গে কানাইলালের শরীরে প্রতিস্থাপন করেছেন আশরাফের দান করা একটি কিডনি। বর্তমানে দু’জনেই সুস্থ রয়েছেন। কানাই এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সফল হয়েছে প্রতিস্থাপন। ভালো আছেন কানাইলাল।
কানাইলালের পরিবার জানিয়েছে, ‘আশরাফকে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। আমাদের কাছে আশরাফ আলি যেন এক ঈশ্বরপ্রেরিত দূত!’ অন্যদিকে, আশরাফের আত্মীয়রা বলেছেন, ‘ও নিজের জীবন বিপন্ন করে একজন মরণাপন্ন মানুষের জীবনরক্ষা করতে পারে তা কোনও দিন কল্পনাতেই আসেনি। গর্বে ফুলে উঠছে আমাদের বুক।’ গ্রামের মিলাদে শোনা একটা গজল যে এই আকার ধারণ করে বিশ্বজুড়ে এক সম্প্রীতির বার্তা দেবে, ভাবলে অবাক করে আশরাফকে।