‘সান স্ট্রোক’ হলে কী করবেন আর কী করা উচিৎ নয় জানাচ্ছেন মেদিনীপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এর মেডিসিন বিভাগের স্বর্ণপদক প্রাপ্ত চিকিৎসক ডাঃ কলিমুজ্জামান মোল্লা
সান স্ট্রোক বা হিট স্ট্রোক কি, কেন হয়?
সান স্ট্রোক যা হিট স্ট্রোক হিসাবেও পরিচিত। গরমকালে সান স্ট্রোক যা হিট স্ট্রোক একটি তীব্র তাপের অসুস্থতা এবং এটা একটি ভয়ংকর জীবন সংশয়কারি সমস্যা। পরিবেশের তাপমাত্রা বেড়ে গেলেও শরীর চেষ্টা করে নিজের তাপমাত্রা বজায় রাখতে। একজন মানুষের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট। যখন প্রচন্ড তাপমাত্রায় আমাদের শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে (থার্মোরেগুলেটরি সেন্টারের ফেলিওরের জন্য) আমাদের শরীরের তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট এর বেশি হলে তাকে সান স্ট্রোক বা হিট স্ট্রোক বলে।
সান স্ট্রোক এ central nervous system- এর কর্মহীনতার জন্য বিভিন্ন লক্ষ্মণ দেখা যায়- যেমন মাথা ব্যথা, মাথা ঘোরা, মাথা ঝিমঝিম করা, অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাওয়া, খিঁচুনি এমনকি অজ্ঞান ও হয়ে যাওয়ার মত সমস্যা দেখা যায়।
সান স্ট্রোক প্রধানত গ্রীষ্ম প্রধান দেশ যেমন ভারত, সৌদি আরব ও অন্যান্য দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে বেশি দেখা যায়। গ্লোবাল ওয়ারমিং এর জন্য সান স্ট্রোকের প্রকোপ ক্রমশ বেড়েই চলেছেই। যদি সান স্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তির অবিলম্বে ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তাহলে এটা শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ প্রতঙ্গকে নষ্ট করে দিতে পারে এবং তা থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। সান স্ট্রোকে মৃত্যুর হার প্রায় ১০-৫০ শতাংশ।
কাদের বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে?
সান স্ট্রোকের প্রধান কারণ হল সূর্যের তাপের সংস্পর্শে সরাসরি আসা। অতিরিক্ত গরম, অধিক শুষ্ক আবহাওয়া, শারীরিক পরিশ্রম দেহে জলের পরিমাণ কমে যাওয়া ও সূর্য তাপের সরাসরি শরীরে প্রবেশের কারণেই এই স্ট্রোক হয়ে থাকে৷ আর এই সমস্যা তাদেরই দেখা দেয় যারা রোদের মধ্যে পরিশ্রমের কাজকর্ম করেন। শিশু থেকে বয়স্ক ব্যক্তি সকলেই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন৷ যারা বেশি মাত্রায় সান স্ট্রোকের প্রবণ তারা হলো-
যাদের আগে সান স্ট্রোক হয়েছে, তাদের সান স্ট্রোক হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের সান স্ট্রোকের ঘটনা অনেক বেশি। শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিদের সান স্ট্রোক হওয়ার প্রবণতা বেশি।স্থুলকায় ব্যক্তি বা মোটা ব্যক্তি, যাদের শরীরে মেদের পরিমাণ বেশি।
যারা মদ্যপান করেন, তাদের সান স্ট্রোক হওয়ার প্রবণতা আছে। রাতে বেশি ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলে বা কেউ যদি নিদ্রাহীনতায় ভোগেন, তাদের সান স্ট্রোক হওয়ার প্রবণতা আছে। মানসিক ভাবে অসুস্থ ব্যক্তি। যারা জল অথবা পানীয় কম গ্রহণ করেন, এর ফলে ডিহাইড্রেশন বা শরীরে জলের ঘাটতি দেখা দেয়।
যারা হৃদরোগ, কিডনির সমস্যা, ফুসফুসের সমস্যায় যারা ভুগছেন তাদের ক্ষেত্রে এই ধরনের স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা বেশি৷
যারা দীর্ঘক্ষণ রোদের মধ্যে পরিশ্রম করেন তারাও এই সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারেন৷
কেউ যদি বর্তমানে জ্বরে ভুগতে থাকেন তাদের ক্ষেত্রে এই ধরনের স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা বেশি৷
কেউ যদি উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে বা অন্য কোনও রোগের চিকিৎসার জন্য নিয়মিত ডাই ইউরেটিক গোত্রের ঔষধ যেমন ডাইটর-ল্যাসিক্স ইত্যাদি নিতে থাকেন, তাদের ক্ষেত্রে এই ধরনের স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা বেশি৷
সান স্ট্রোকের উপসর্গগুলি কি কি?
সান স্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তি নিম্নলিখিত সাধারণ উপসর্গগুলি উপলব্ধি করতে পারেন:
রোদে বেরিয়ে যদি দেখেন শরীরের তাপমাত্রা হঠাৎ অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। গা গরমে পুড়ে যাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে ছায়ায় যান। রোদ এড়ানোর চেষ্টা করুন কারণ এটি সান স্ট্রোকের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষণ।
সান স্ট্রোক হলে অনেক সময়ে ত্বক লাল হয়ে যায় এবং ত্বক জ্বলতে থাকে। এরকম লক্ষণ হঠাৎ করে দেখলে সাবধান হোন এবং চিকিৎসকের কাছে যান। সান স্ট্রোকের আগে ত্বক শুষ্ক আর লালচে হয়ে ওঠে।
ঘাম বন্ধ হয়ে যাওয়া সান স্ট্রোকের একটি অন্যতম লক্ষণ, আবার অনেক সময় সান স্ট্রোক হলে প্রচণ্ড পরিমাণে ঘাম ও হয়।
সান স্ট্রোকের আগে সবকিছু গুলিয়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, খিটখিটে ভাব, বমি বমি ভাব বা বমি হতে পারে।
কাঠফাটা রোদে হঠাৎ বেরিয়ে যদি দেখেন হঠাৎ মাথা ব্যাথা, মাথা ঘোরা, অস্থিরতা অনুভব করেন তাহলে সাবধান হোন।
সান স্ট্রোকের আগে ক্লান্তি গ্রাস করে, মাথা ঝিমঝিম করা, শরীরে খিঁচুনি হওয়া, এমনকি অজ্ঞান ও হয়ে যেতে পারে।
রোদে গরমে চলতে ফিরতে হঠাৎ যদি নিজের শরীর, পেশী, হাত-পা অবশ হয়ে যেতে থাকে তাহলে সাবধান হোন।
রোদে বেরিয়ে যদি হঠাৎ করে চোখের সামনে সব আবছা দেখতে থাকেন বা চারিদিকে অন্ধকার হয়ে গেলে, শীঘ্রই চিকিৎসকের কাছে যান। সান স্ট্রোকে এমন হয়েই থাকে।
রোদে বেরিয়ে হঠাৎ করে যদি দেখেন খুব দ্রুত হৃদস্পন্দন চলছে, তাহলে সতর্ক হোন। সান স্ট্রোকের শিকার হলে এটা হয়ে থাকে। সান স্ট্রোকের আগে রক্তচাপ অস্বাভাবিক ভাবে কমে যায়।
শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে যায়। এ সময় শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে প্রস্রাবের পরিমাণ অনেকটাই কমে যায়।
গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে সতর্ক থাকুন ও সান স্ট্রোকের উপসর্গগুলির দিকে নজর দিন। উপরের উপসর্গগুলি দেখা দিলে, চিকিৎসককে দেখাতে দেরি করবেন না।
সান স্ট্রোক বা হিট স্ট্রোক আক্রান্তের প্রাথমিক চিকিৎসা কি হওয়া উচিৎ?
যেকোন ব্যক্তি, যেকোন সময় সান স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারে৷ তাই অবশ্যই জেনে রাখা প্রয়োজন এই ধরনের পরিস্থিতিতে কী করবেন৷
সান স্ট্রোক হলে আক্রান্তকে যত দ্রুত সম্ভব ঠাণ্ডা পরিবেশে সরিয়ে আনতে হবে এবং অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা জায়গায় শুইয়ে দিতে হবে৷ সম্ভব হলে সান স্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বাতানুকূল (এয়ারকন্ডিশন) ঘরে রাখতে হবে।
যে কোনও উপায়ে সান স্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের তাপমাত্রা কমানোর চেষ্টা করতে হবে। সান স্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর জলে ভেজানো কাপড় দিয়ে মুছিয়ে দিতে হবে। প্রয়োজনে ভেজা কাপড় দিয়ে কিছুক্ষণ জড়িয়ে রাখতে হবে।
রোগীর ঘাড়ের নীচে, হাতের তলায়, পেটের নীচের অংশে বরফ দিতে হবে যাতে শরীরের তাপমাত্রা কম হয়ে যায়৷ দেহের তাপমাত্রা ১০১-১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইটে না পৌঁছানো পর্যন্ত এটি করতে হবে৷
ঘরের পাখা চালিয়ে রাখতে হবে ও পর্যাপ্ত হাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে রোগীর নিঃশ্বাসে কোন অসুবিধা না হয়৷
এই সময় রোগীকে কোনও ধরনের জ্বরের ওষুধ একেবারেই দেওয়া যাবে না।
যদি এতেও দেহের তাপমাত্রা না কমে তবে অবিলম্বে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে৷
প্রাথমিক পর্যায়ে সান স্ট্রোকের মোকাবিলা করার পর যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে যান। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে।
সান স্ট্রোক বা হিট স্ট্রোক যাতে না হয় তার জন্য কি কি সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন?
নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলি মেনে চললে নিজেই নিজেকে সান স্ট্রোক বা হিট স্ট্রোক থেকে রক্ষা করতে পারেন।
হাল্কা রঙের পাতলা ও ঢিলেঢালা সুতির পোশাক পরুন, যাতে সহজেই বাতাস চলাচল করতে পারে। খুব আঁটোসাঁটো পোশাক না পরাই ভালো।
জলের বোতল, ছাতা ও রোদচশমা সঙ্গে অবশ্যই রাখুন। টুপি অথবা স্কার্ফ পরার পাশাপাশি ছাতা ব্যবহার করুন। এতে কিছুটা হলেও রোদ এড়াতে পারবেন। ব্যাগে ওয়েট ওয়াইপ রাখুন। খুব গরম লাগলে তা দিয়ে মুখ, ঘাড় ও কানের পিছন মুছে নিন। রোদ থেকে বাঁচতে অবশ্যই সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন।
শরীরে জলের মাত্রা ঠিক রাখতে, পর্যাপ্ত পরিমাণে জল খান। সম্ভব হলে মাঝে মধ্যে (ডাবের জল বা পাতিলেবুর সরবত খেতে পারেন।
হালকা তেল ও মশলাযুক্ত সহজ পাচ্য খাবার খান। এমন খাবার খান যাতে জলের পরিমাণ বেশি থাকে, এর ফলে আপনার শরীর হাইড্রেটেড থাকবে। বেশি বেশি করে শাক শবজী ও ফলমূল খান। রেডমিট যতটা পারেন এড়িয়ে চলুন।
যাঁদের দিনের বেশির ভাগ সময় বাইরে খোলা আকাশের নীচে কাটাতে হয় বা রোদে বেশি ঘোরাঘুরি করতে হয়, তাঁদের একটানা বেশিক্ষণ পরিশ্রমের কাজ না করাই ভালো। ছোট ছোট বিরতি নিয়ে কাজ করাই ভাল। দুপুর ১২টা থেকে ৩টে পর্যন্ত সূর্যের তাপ প্রখর থাকে, এই সময় যতটা সম্ভব রোদ্দুরে কম থাকুন।
রোদের মধ্যে পার্ক করা গাড়িতে বসে থাকবেন না। যদি জানালা বন্ধ করে রোদের মধ্যে গাড়ি পাকিং করা থাকে সেক্ষেত্রে গাড়ির ভিতরের তাপমাত্রা অনেক বেশি বেড়ে যায়, তাই রোদের মধ্যে পাকিং করা গাড়িতে হঠাৎ করে বসবেন না, এতে আপনি সান স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারেন। ভুলেও পার্কিং করা গাড়িতে বাচ্চাদের বা বয়স্ক ব্যক্তিদের কে বসিয়ে রেখে যাবেন না।
যে সমস্ত ব্যক্তি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও হার্ট এর রোগে ভুগছেন-বিশেষে করে তাঁদের রোদ এড়িয়ে চলা উচিত। খুব প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে রোদে বেরোবেন না। ঘর থেকে বেরতে হলে নিজের প্রয়োজনীয় ওষুধ সঙ্গে নিয়ে বেরোন।