পুবের কলম ওয়েবডেস্কঃ একেই বলে শঠে শাঠ্যং। বুধবার নিউটাউনের বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের মঞ্চ থেকে উন্নয়নের প্রশ্নে বিবাদ ভুলে কেন্দ্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করার জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়কে পরামর্শ দিয়েছিলেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়। স্পষ্ট করে না বললেও তাঁর লক্ষ্য ছিল, কেন্দ্র-রাজ্য সংঙ্ঘাতের সম্পর্ক নিয়ে খোঁচা দেওয়া। মঞ্চে দাঁড়িয়ে রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধানের সেই খোঁচার মোক্ষম জবাব দিলেন মুখ্যমন্ত্রীও। রাজ্যপালের উদ্দেশে বললেন, ‘রাজ্যের উন্নয়নে আমরাও কেন্দ্রের কাছ থেকে যাবতীয় সাহায্য পেতে চাই। কিন্তু আপনাকে অনুরোধ জানাচ্ছি রাজ্যে যাঁরা বিনিয়োগ করবেন সেই শিল্পপতিদের যেন কোনওভাবে কেন্দ্রীয় সংস্থা (পড়ুন সিবিআই, ইডি, আয়কর) দিয়ে হেনস্তা করা না হয়, সেই বার্তা পৌঁছে দিন।’ রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের জবাবে অস্বস্তিতে পড়লেও দেঁতো হাসি হেসে বিড়ম্বনা আড়ালের চেষ্টা করলেন ধনকড়।
করোনার কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে রাজ্যে বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের আসর বসতে পারেনি। দু’বছর বাদে ফের বাণিজ্য সম্মেলন আয়োজন করেছে রাজ্য। দু’দিনের বাণিজ্য সম্মেলনের প্রথমে দিনেই বিনিয়োগকারীদের মন জয় করতে পেরেছেন মুখ্যমন্ত্রী। গৌতম আদানি থেকে সজ্জন জিন্দল, নিরঞ্জন হীরানন্দানি থেকে সঞ্জীব গোয়েঙ্কা-সবাই বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসা করেছেন। সম্মেলনের প্রথম দিনের প্রথমার্ধের শেষের দিকে শিল্পপতি ও বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে বাংলার সরকার যে শিল্পবান্ধব সেই বার্তা তুলে ধরতে গিয়ে মমতা বলেন, ‘রাজ্যে এখন আর কোনও কর্মদিবস নষ্ট হয় না। কথায়-কথায় বনধ হয় না। ক্ষমতায় এসে আমি কর্মসংস্থানের দিকে নজর দিয়েছিলাম। কৃষি ও শিল্প পাশাপাশি হাত ধরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করুক, তাই চেয়েছিলাম। আজ দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জিডিপি বাংলার। করোনার কালবেলায় ৩ দশমিক ৮ গুণ বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে। রাজস্ব আয় বেড়েছে চার গুণ। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার গেটওয়ে বাংলা। আজ ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্প ও স্কিল ডেভেলপমেন্টে এগিয়ে। শিল্পের উন্নয়নের জন্য ২০০-র বেশি শিল্প পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। রাজ্যে শিল্প-বাণিজ্যে বিনিয়োগ আরও সহজ করতে কর কাঠামো-সহ একাধিক ব্যবস্থাকে সরল করা হয়েছে। সিঙ্গল উইন্ডো ব্যবস্থা চালু করেছে সরকার। সামাজিক ক্ষেত্রকেও ভুলিনি। রাজ্যে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়া যায়। স্বাস্থ্যসাথী কার্ড চালু করেছি। কৃষকদের বছরে ১০ হাজার টাকা করে বিশেষ ভাতা দিচ্ছি। নারীদের ক্ষমতায়নের উপরে বিশেষ জোর দিয়েছি। আমাদের নির্বাচিত মহিলা প্রতিনিধি ৩৮ শতাংশ।’
দেশি শিল্পপতি কিংবা বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কেন বাংলায় আসবেন, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কিছুটা হালকা চালে মমতা বলেন, ‘যদি আপনি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বাঘ রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার দেখতে চান, তাহলে বাংলায় আসতে হবে। যদি সূর্যোদয় দেখতে চান, তাহলে দার্জিলিংয়ে অর্থাৎ বাংলায় আসতে হবে। যদি বঙ্গোপসাগরের শোভা উপভোগ করতে চান, তাহলেও বাংলায় আসতে হবে।’
ভাষণের শেষাংশে গিয়ে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমাতেই কেন্দ্রীয় সরকারকে খোঁচা দিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। মঞ্চে বসা রাজ্যপালের উদ্দেশে হাত জোড় করে বলেন, ‘আমরাও কেন্দ্রের কাছ থেকে সব ধরনের সাহায্য পেতে চাই। কিন্তু এখানে বসে থাকা সমস্ত শিল্পপতিদের পক্ষ থেকে আমার একটাই অনুরোধ, ওরা মুখ খুলতে পারেন না। শুধু আপনাকে অনুরোধ করছি, বাংলায় যাঁরা বিনিয়োগ করবেন, সেই শিল্পপতিদের যেন কেন্দ্রীয় সংস্থা দিয়ে হেনস্তা করা না হয়। আপনি শুধু কেন্দ্রের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিন।’ মুখ্যমন্ত্রীর এমন আর্জি শুনে কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়লেও হাসিমুখেই পরোক্ষ খোঁচা হজম করেছেন রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, ‘বাংলায় বিনিয়োগে ইচ্ছুক বড় শিল্পপতিদের না হলেও মাঝারি শিল্পপতিদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার সিবিআই-ইডি ও আয়কর দফতরকে লেলিয়ে দিতে পারেন, এমন আশঙ্কা থেকেই এদিন শিল্পপতিদের হেনস্তা না করার অনুরোধ জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।’ দ্বিতীয়ার্ধে সম্মেলনে যোগ দিতে আসা বিদেশি প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপচারিতায় অংস নেন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান। রাজ্যে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তাঁরা কী ধরনের সাহায্য চান, তা নিজের মুখেই শোনেন মমতা।