শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায় : মেয়েদের শারীরিক পরিবর্তনের সময়টাকে স্পষ্টত তিনভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত- বয়ঃসন্ধির পরে, দ্বিতীয়ত- মাতৃত্বকালীন আর তৃতীয়ত মেনোপজের পর। আর এই তিন সময়ে মানসিক সমস্যাও প্রায় সাধারণ ঘটনা। প্রথম থেকে সচেতনভাবে মোকাবিলা না করলে সমস্যা বড়সড় আকার নিতে পারে।
ঝড়ঝঞ্ঝার সময়
বয়ঃসন্ধির আগে ডিপ্রেশনের হার ছেলেমেয়েদের প্রায় সমান থাকে। বরং মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের একটু বেশিই দেখা যায়। কিন্তু বয়ঃসন্ধির পরেই ব্যাপারটা পুরো উল্টে যায়। তখন মেয়েরাই বেশি এই সমস্যায় ভোগে। কারণ হল মেনস্ট্রুয়াল সাইকেল। পিরিয়ড শুরু হওয়ার পরে কখনও কিছু হরমোন বেড়ে যায় আবার কখনও কিছু কমেও যায়। এর প্রভাব পড়ে শরীরে ও মনে।
প্রায় ৮০ শতাংশ মেয়ের পিরিয়ড শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহে একটি বা একাধিক মানসিক ও শারীরিক পরিবর্তন দেখা দেয়। এই অবস্থাকে বলা হয় প্রিমেনস্ট্রুয়াল সিনড্রোম বা সংক্ষেপে পিএমএস। এ সময়ে যেসব মানসিক উপসর্গ দেখা দিতে পারে তাহল মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, অকারণে বা সামান্য কারণে কান্নাকাটি করা, হঠাৎ করে রেগে যাওয়া, মন খারাপ লাগা, টেনশনের জন্য ঘুম না হওয়া। অন্যদিকে শারীরিক উপসর্গ হিসাবে পেট ফাঁপা, মাথা ব্যথা, পা ফোলা, বুকে চাপ লাগা কিংবা স্তন ব্যথা হওয়ার অভিজ্ঞতা হতে পারে। ৪০ শতাংশ মেয়ের এই সমস্যা তীব্র হতে পারে। তার মধ্যে ৫-৭ শতাংশ মেয়ের সমস্যা এতটাই তীব্র হয় যে স্বাভাবিক কাজকর্মও ঠিকমতো করতে পারে না। সাধারণত পিরিয়ড শুরু হওয়ার ৭ দিন আগের থেকে এই সমস্যা শুরু হয়। পিরিয়ড শুরু হলে কয়েকদিনের মধ্যে সেসব সমস্যা ঠিক হয়ে যায়। প্রিমেনস্ট্রুয়াল ডিসফোরিক ডিসঅর্ডার বা পিএমডিডি এর উপসর্গ প্রায় একইরকম। যেমন মুড সুইং, রাগ, মন খারাপ, মনোযোগের অভাব, শারীরিক দুর্বলতা, খিদে কমে কিংবা বেড়ে যাওয়া, ঘুমের সমস্যা ও টেনশন।
পিএমএস এর সমস্যা হলে কী করণীয়?
মনের একটু যত্ন নিতে হবে। করতে হবে শরীরচর্চা। গান শোনা, তর্ক-ঝামেলা এড়িয়ে চলা, নিজেকে ভাল রাখার চেষ্টা করা। কিন্তু যদি কিছুতেই সমস্যা থেকে বেরতে না পারেন এবং দিনে দিনে তা বাড়তে থাকে তাহলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে দেরি করা ঠিক নয়।
প্রজনন কালের সমস্যা
বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করার পরেই মেয়েদের জীবনে আরেক পর্বের শুরু। এই পর্বে মাতৃত্ব নিয়ে চিন্তাভাবনা থাকে প্রায় প্রতিটা মেয়ের। এর সঙ্গে ভাল লাগা, মন্দ লাগা, ভয় সব মিশে থাকে। কোনও মেয়ের বাচ্চা হলে সে কেন মেয়ে বা ছেলে হল তা নিয়ে যেমন নানারকম প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়, তেমনই মা হতে না পারলে নানারকম মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়। নিজের মধ্যেও দেখা দেয় অপরাধবোধ, নিজেকে অক্ষম ভাবা। আবার সন্তান হওয়ার পরেও তার যাবতীয় দুষ্টুমির, অসুখের দায় মায়ের ওপরেই চাপানো হয়। এমনিতেই মা হওয়ার পরে পরেই কিছু আবেগগত সমস্যা অনেকেরই হয়। যেমন, মুড সুইং, মনখারাপ, কান্নাকাটি করা। আসলে সদ্য মা হওয়ার পরে হরমোনের কিছু তারতম্য, মা হওয়ার ধকল ও মায়ের দায়িত্ব পালন করা নিয়ে অনেক মা একটু দিশেহারা হয়ে পড়েন। এই অবস্থাকে বলা হয় বেবি ব্লুজ। বাড়ির লোকের সহযোগিতা পেলে এই অবস্থা ঠিক হয়ে যায়।
যদিও সদ্য মায়েদের ১০-১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে পোস্টপারটাম ডিপ্রেশন হতে পারে। এই সমস্যা শুরু হয় বাচ্চা হওয়ার ১২ সপ্তাহের মধ্যে। অনেক সময়ে মায়েদের মুড ডিসঅর্ডারের পারিবারিক ইতিহাস থাকে। তাদের মনখারাপ ছাড়াও অবসাদ, ঘুমের সমস্যা, বাচ্চার ক্ষতি করার ভয় এমনকী আত্মহত্যার চিন্তাও দেখা দেয়। সময়মতো চিকিৎসা না করা হলে তা কয়েক মাস থেকে অনেকদিন স্থায়ী হতে পারে। পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের থেকে আর ধাপ বেশি জটিল সমস্যা হল পোস্ট পার্টাম সাইকোসিস। এই সমস্যা বাচ্চার জন্মের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে হতে পারে। তখন ডিপ্রেশন ছাড়াও বাচ্চার ক্ষতি করার কিংবা আত্মহত্যা করার প্রবণতা দেখা যায়। অনেক সময়ে মা মনে করে তার বাচ্চা মৃত আবার কেউ কেউ মাতৃত্বকেই অস্বীকার করে। এরকম কোনও সমস্যা দেখা দিলে একটুও সময় নষ্ট না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। নয়তো মা ও বাচ্চার দুজনেরই ক্ষতির আশঙ্কা থাকবে।
মেনোপজ পরবর্তী সময় মানসিক সমস্যা
মেয়েদের দেহে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের প্রভাবে পিরিয়ডের চক্র চলতে থাকে। কিন্তু একটা বয়সের পর ইস্ট্রোজেন কমতে থাকে। কমতে থাকে ঋতুস্রাব পরিমাণও। আর এক সময় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ঋতুবন্ধ বা মেনোপজের প্রধান লক্ষণ হল হট ফ্ল্যাশ অর্থাৎ আচমকা প্রচণ্ড গরম লাগা। এছাড়া নাইট সোয়েট বা রাতে ঘেমে যাওয়া, অল্পতেই হাঁপিয়ে যাওয়া, ডিপ্রেশন বা মুড সুইং, অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। অস্টিওপোরোসিসের আশঙ্কা বেড়ে যায় বলে চলাফেরায়ও আড়ষ্টতা আসে। আগের মতো দৌড়ঝাঁপ করা সম্ভব হয় না। অনেক মেয়ে এই পরিবর্তনগুলো সহজে মানতে পারে না। এছাড়া এতদিন যে মায়েরা সন্তান, সংসার সামলাতে একরকম দম নেওয়ার ফুরসত পেতেন না, ছেলেমেয়েরা চাকরি, বিয়ে কিংবা পড়াশোনার জন্য অন্যত্র চলে যাওয়ায় অঢেল সময় হাতে। এই সব কারণ মিলে মানসিক অবসাদ, একাকীত্ব দেখা দেয়। তখন সামান্য কারণে রেগে যাওয়া, খিটখিটে মেজাজ, নিজেকে অসহায় ভাবার মতো মানসিক কিছু সমস্যা হতে পারে।
এমনিতে মেনোপজ তেমন কোনও সমস্যা নয়। বেশিরভাগ মহিলা নিজেরাই সব সামলে নেয়। কিন্তু শারীরিক সমস্যা বেশি হলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া দরকার। আর মানসিক সমস্যা বেশি হলে মনোবিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার। তবে এই সময়ের জন্য যদি আগে থেকেই মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া থাকে তাহলে সমস্যা কাছে ঘেঁষতে পারে না। যেমন, পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে মাঝে মধ্যে দেখা করা, শরীরচর্চা করা, শুধু টিভি দেখে নয়, স্বামীর সঙ্গে সময় কাটানোর নতুন পথ খুঁজে বার করা যেমন সকালে হাঁটতে যাওয়া, সময়-সুযোগমতো বেড়াতে যাওয়া কিংবা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা এরকম ভাবে সময়টা উপভোগ করলেই আর কোনও সমস্যাকে সমস্যা বলে মনে হবে না।