রিনা লায়লা, ইসলামপুর/ ইনামুল হক,বসিরহাট: উত্তর দিনাজপুর কোচবিহার ও উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় দরিদ্র চাষিরা সীমান্ত এলাকায় অর্থকরি ভুট্টা ও পাট চাষ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। কারণ, বিএসএফ সীমান্ত এলাকায় এই ফসলগুলির চাষে বাধা দিচ্ছে। তারা একপ্রকার নিষেধাজ্ঞাই জারি করেছে। অন্যদিকে জেলাগুলির কৃষি আধিকারিকরাও বিএসএফ-এর নিষেধাজ্ঞায় সমর্থন দিচ্ছেন। তাঁরাও প্রচার করছেন সীমান্ত এলাকায় ভুট্টা ও পাট চাষ করবেন না। ফলে গরিব চাষিরা খুবই আতান্তরে পড়েছেন। কোথাও কোথাও তাঁরা প্রতিবাদও জানাচ্ছেন। ফলে দু-একটি জেলায় বিএসএফ প্রশাসন ও চাষিদের মধ্যে বৈঠকও হয়েছে। কিন্তু চাষিরা বলছেন তাঁরা খুব একটা সাড়া পাননি।
পাট ভুট্টার মতো বড় গাছ থাকলে নজরদারির সমস্যা হয়। এই অভিযোগ তুলে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় এধরনের ফসল চাষে নিষেধাজ্ঞা জারি করল বিএসএফ। উত্তর দিনাজপুরে কাঁটাতারের বেড়া লাগোয়া জমিতে পাট ও ভুট্টার চাষে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করায় বিপাকে পড়েছেন চাষিরা।
উত্তর দিনাজপুর একটি সংখ্যালঘু প্রধান জেলা। জেলাটি দারিদ্র পীড়িত ও কৃষি নির্ভর। এখানে চাষিদের জীবিকার একটি বড় ভরসা হল পাট চাষ। আর ভুট্টা চাষেও নানা কারণে তাদের জন্য লাভজনক। অন্যদিকে, উত্তর দিনাজপুরের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশে। আর সেজন্য এখানে সীমান্ত রক্ষায় রয়েছে বিএসএফ-এর স্বাভাবিক উপস্থিতি।
দেশভাগের পর চাষিরা এখানে বিনা বাধায় চাষ করত। কিন্তু প্রথম সমস্যার সৃষ্টি হয় কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার ফলে। এখন আবার নতুন করে আদেশ জারি করা হয়েছে, সীমান্ত এলাকায় পাট ও ভুট্টার চাষ করা চলবে না। ঐতিহ্যগতভাবে চাষিরা এখানে পাট ও ভুট্টার চাষ করে আসছেন। ফলে দরিদ্র চাষিদের মাথায় হাত পড়েছে। বিকল্প হিসেবে তাঁরা অন্য কিছু ভেবে পাচ্ছেন না। চাষিরা বলছেন, তাঁদের জীবন-জীবিকায় টান পড়বে।
অন্যদিকে, তাঁরা আবার রাজ্য কৃষি দফতরেরও কোনও সহায়তা পাচ্ছেন না। উলটে উত্তর দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় কৃষি দফতরের পক্ষে প্রচার করা হচ্ছে যে, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে কোনও জমিতে পাট ও ভুট্টা চাষ করা যাবে না। দফতরের আধিকারিকরা সীমান্তের গ্রামে গ্রামে গিয়ে চাষিদের সে কথা বলছেন। আর এই নিষেধাজ্ঞায় উত্তর দিনাজপুরের সীমান্তের পাট চাষিদের মাথায় হাত পড়েছে। জেলার নটি ব্লকেই পাট ও ভুট্টা চাষ হয়। উত্তর দিনাজপুরের প্রায় দু’লক্ষ চাষি ভুট্টা চাষের সঙ্গে যুক্ত। পাট চাষের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন প্রায় লক্ষাধিক চাষি।
জেলার ইসলামপুর, চোপড়া, গোয়ালপোখর,করণদিঘি, রায়গঞ্জ, হেমতাবাদ ও কালিয়াগঞ্জে বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে। বিএসএফ সূত্রে জানা গিয়েছে, বাংলাদেশ সীমান্তে যে কাঁটাতারের বেড়া আছে, সেখান থেকে ৫০০ মিটার জমিতে পাট ও ভুট্টা চাষ তাঁরা করতে দেবেন না। কারণ পাট ও ভুট্টা গাছ উচ্চতায় বেশি লম্বা হওয়ায় সীমান্তে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হয়।
চাষিদের অভিযোগ পাট চাষের জন্য ধার-দেনা করে ট্রাক্টর দিয়ে জমি নিড়ানো হয়েছে। পাটের বীজ বোনার মুখে বলা হচ্ছে কাঁটাতারের বেড়া থেকে এক কিলোমিটার পর্যন্ত জমিতে পাট চাষ করা যাবে না।
গোয়ালপোখরের শ্রীপুর গ্রামের চাষি হাসিব আলম বলেন, কাঁটাতারের বেড়ার এপারেই আমার পাঁচ বিঘা জমি রয়েছে। এবার আলু চাষ করি। তারপর পাট চাষের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। এখন শেষ মূহূর্তে কোথায় যাব?
এ বিষয়ে গোয়ালপোখরের মন্ত্রী গোলাম রাব্বানি বলেন, কৃষিকাজের সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। সীমান্ত এলাকার কৃষকরা যাতে কোনও রকম ভাবে সমস্যায় না পড়েন সেটা প্রশাসনিকভাবে দেখা হবে বলে আশ্বাস দেন তিনি।
কিন্তু সীমান্তে পাট ও ভুট্টা চাষে কেন এই নিষেধাজ্ঞা? কী বলছেন প্রশাসনিক কর্তারা? জেলা প্রশাসনের এক কর্তা জানান, বিএসএফের নির্দেশে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার স্বার্থে সীমান্তের ভারত-বাংলাদেশ সংলগ্ন এলাকায় ভুট্টা ও পাট চাষে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
এ দিকে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৫০ কিলোমিটার এলাকার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব বিএসএফ-এর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। আর তখনই আপত্তি উঠেছিল, বিএসএফ ধীরে ধীরে সীমান্তের এই বিস্তীর্ণ এলাকায় নিজের প্রতিপত্তি বাড়াবে আর অসুবিধায় পড়বেন সাধারণ বাসিন্দারা। এখন সীমান্ত এলাকাতেই পাট ও ভুট্টার চাষ নিয়ে প্রবল সমস্যায় পড়েছেন সাধারণ কৃষকরা।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের জিরো পয়েন্ট থেকে শুরু করে ভেতরে চাষযোগ্য জমিতে পাট গাছ লাগানো যাবে না। এই নিয়ে ফি-বছর বিএসএফ ও স্থানীয় চাষিদের মধ্যে সমস্যা তৈরি হয়। উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগর ব্লকের কৈজুরী, বালতি, নিত্যানন্দ কাটি বিথারী, হাকিমপুর ও গোবিন্দপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রায় ৪৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকায় কয়েকশো একর জমিতে পাট চাষে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ায় ক্ষোভ তৈরি হয়েছে চাষিদের মধ্যে। তাঁদের মতে, কাঁটাতারের বেড়া থেকে দু’দিকেই রয়েছে এমন জমি যা পাট চাষের উপযোগী। কিন্তু পাট চাষ করতে না দিলে এই জমি থেকে অন্য চাষে তেমন কোনও লাভের মুখ দেখতে পায় না তারা। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবছর মার্চ-এপ্রিলে তারা স্থানীয় প্রশাসনের কাছে দরবার জানিয়ে পাট চাষ করতে চায়। কিন্তু বিএসএফ-এর তাতে আপত্তি।
তাদের দাবি, পাটগাছ একটু বড় হলেই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বা চোরাচালানকারীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। নজরদারিতে বাধা সৃষ্টি হয় এই পাটগাছে। সপ্তাহখানেক আগেই এ নিয়ে একটি প্রশাসনিক মিটিং হয় স্বরূপনগর ব্লকের সভাঘরে। সেখানে হাজির ছিলেন ১১২ নম্বর ব্যাটেলিয়ান-এর আধিকারিক এবং ১৫৩ নম্বর ব্যাটেলিয়ানে কোম্পানি কমান্ডার-সহ বিএসএফের কর্মকর্তারা। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন স্বরূপনগরের বিডিও কৃষ্ণ গোপাল ধাড়া পঞ্চায়েত সমিতির সহকারী সভাপতি প্রদীপ্ত মণ্ডল বন ও ভূমি কর্মাধ্যক্ষ রমেন সরদার কৃষি কর্মাধ্যক্ষ-সহ সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েতের প্রধানরা।
চাষিদের দাবি, বিএসএফ তাদের ওয়াচ টাওয়ার থেকে নজরদারি চালালে সেক্ষেত্রে পাট গাছ কোন বাধা হতে পারে না। তাছাড়া অধিকাংশ জমি নিচু হওয়ায় তিল বা ধান চাষের ক্ষেত্রে অতিবৃষ্টিতে সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা থেকে যায়। এক্ষেত্রে পাট চাষই একমাত্র লাভজনক। এই পরিস্থিতিতে আলোচনা সভায় কৃষকদের একাংশ বিএসএফের আবেদনে বিকল্প চাষে সায় দিলেও কৈজুরী গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার চাষিরা সহমত হতে পারেননি। বাস্তব সমস্যা সরজমিনে প্রত্যক্ষ করে পরিস্থিতি নিয়ে আরও আলোচনা হওয়া দরকার বলে মনে করেন তারা। পাশাপাশি চাষিদের সহায়ক ব্যবস্থার দাবি জানান তাঁরা।