হাবিব মণ্ডল, (দক্ষিণ বারাসত): বাংলা একটি গান আছে— ‘জীবনটা যায় ঝরে ঝরে ফুলদানি না জোটে’। ব্যক্তি জীবনের মূল্যায়ন না হওয়া কিংবা অবহেলা-বঞ্চনাময় জীবনকে হয়তো রূপক অর্থে এইভাবে বলা হয়েছে। তবে প্রকৃতই বহু গুণে সমৃদ্ধ হয়েও জীবনের ফুলদানি জোটে না অর্থাৎ সমাদৃত হয় না আমাদের চির পরিচিত উদ্ভিত ‘ভাটফুল’। দেশের বন-জঙ্গল ঝোপঝাড়ে অযত্ন অবহেলায় বেড়ে উঠে এই গাছ। বসন্ত এলে সাদা সাদা ফুলে ছেয়ে যায় তখন গাছ থেকে সহজে চোখ ফেরানো যায় না। অথচ অন্যান্য বহু ফুলকে সমাদর করলেও ভাঁটফুলকে আমরা অবহেলাই করি। সেসব ফুলকে অতি যত্নে ফুলদানিতে ঠাঁই দিলেও গ্রামবাংলার আনাচে-কানাচে মাথা দোলালেও কদর পায় না। হতে পারে ভাঁটফুল অনাদৃত হওয়ার নেপথ্যে দায়ী এই উদ্ভিদ সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা।
গুল্ম জাতীয় দেশি বুনো উদ্ভিদ ফুল গাছটি ভাঁট বলে পরচিতি হলেও স্থানভেদে এবং ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীতে এর ভিন্ন ভিন্ন নাম। দেশি বুনো এই উদ্ভিদের বিজ্ঞানসম্মত নাম– ক্লেরোডেনড্রাম ভিসকোসাম। এর পাতা ৪ থেকে ৭ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। বোঁটা ১ থেকে ৩ ইঞ্চি লম্বা। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ফুলের গন্ধেও পরিবর্তন আসে। পাপড়ির রং সাদা এবং এতে বেগুনি রঙের মিশেল আছে। বসন্ত থেকে গ্রীষ্ম অবধি ফুল ফোটে। এই ফুলের রয়েছে মিষ্টি সৌরভ।
গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ দৈনন্দিন জীবনে ভাট গাছের পাতা, ফল, ফুল, মূল আয়ুর্বেদিক ঔষুধি হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ভাঁট পাতা এবং ফুল দু’টোরই রয়েছে ঔষুধি গুণ। বিষাক্ত কিছু কামড়ালে ভাট ফুলের রস ক্ষত স্থানে দিলে দ্রুত সেরে যায়। অনেকে কৃমি দূর করার জন্য এই ফুলের রস খেয়ে থাকেন। চর্ম রোগে নিয়মিত ফুলের রস ক্ষত স্থানে মালিশ করলে দ্রুত সেরে যায়। এর পাতার রস শিশুর জ্বর দূর করে। এতে প্রচুর পরিমাণে ফ্ল্যাভোনয়েড থাকে। ফ্ল্যাভোনয়েড থাকার জন্য এটি ক্যানসার দমনে সহায়ক। এছাড়াও কৃমি, চুলকানি, কোলেস্টেরল ব্লাড সুগার ও উদরাময় প্রভৃতি রোগ নিরাময়ে এটি সাহায্য করে।
এক সময় গ্রামীণ পথঘাটে প্রচুর ভাট গাছ দেখা গেলেও এখন খুব বেশি চোখে পড়ে না। বসতবাড়ি বেড়ে যাওয়ায় ঝোপঝাড় কেটে ফেলা হচ্ছে। তাছাড়া প্রতিবছর রাস্তা-ঘাট সংস্কার করায় গাছের সংখ্যা অনেকাংশে কমে গেছে। কিন্তু আগের লোকজন ভাট ফুলের ভেষজ ঔষধিগুণ জেনে এসব চিকিৎসা করত। বর্তমান প্রজন্ম এ গাছের গুণাগুণ সম্পর্কে জানে না। তাই এ উদ্ভিদ সংরক্ষণ করা জরুরি। এত গুণ সত্ত্বেও আর পাঁচটা সুগন্ধি ফুলের মতো এই ফুলের চাষ হয় না। যত্ন করে কেউ ঠাঁই দেয় না ফুলদানিতে। প্রাপ্তি বলতে কেবল অনাদর-অবহেলা। তবুও সে নিজে নিজেই নীরবে সৌন্দর্য বিলিয়ে যায়। গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলে মাথা দুলিয়ে আহ্বান করে প্রকৃতি ও ফুলপ্রেমীদের।