মার্চের ২ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এন্ডোমেট্রিওসিস সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর প্রচার করা হয়। ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট ফর রিসার্চ ইন রিপ্রোডাকটিভ অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ এবং এন্ডোমেট্রিওসিস ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড জেনেটিক রিসার্চ ইন্ডিয়া যৌথভাবে এই কর্মসূচি গ্রহণ করে। এই অসুখ সম্পর্কে অনেকের কোনও ধারণা না থাকলেও প্রায় মহামারির আকার নিয়েছে এই অসুখ। কেন এই সমস্যা নিয়ে সচেতনতা এতটা জরুরি, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে লিখছেন শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়।
বহু মেয়েরই সারা মাসের শান্তি উধাও হয়ে যায় মাসের ওই বিশেষ কয়েকদিনের টেনশনে। এর জন্য দায়ী এন্ডোমেট্রিওসিস নামের সমস্যা। ২ কোটি ৫০ লক্ষের বেশি মহিলা আমাদের দেশে এই সমস্যার শিকার। প্রতি দশজনে একজনের এই সমস্যা আছে। নামী সেলিব্রিটি থেকে একেবারে সাধারণ ঘরের মেয়ে অনেকেই এই অসুখে আক্রান্ত। ঘরের মেয়েরা যন্ত্রণায় শয্যাশায়ী হয়ে থাকলেও তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা অনেক অভিভাবক ভুলেও ভাবেন না। তাঁদের কাছে, এটা সহ্য করেই নিতে হয়। আধুনিক চিকিৎসার কোনও প্রয়োজনীয়তাই মনে করেন না। যদিও সময় থাকতে চিকিৎসা শুরু না হলে এর থেকে বন্ধ্যাত্বও দেখা দিতে পারে।
এন্ডোমেট্রিওসিস সম্পর্কে বিশিষ্ট বন্ধ্যাত্ব বিশেষজ্ঞ ডা. ভিমি বিন্দ্রা জানান, পিরিয়ড শুরু হওয়ার সময় থেকে মেনোপজ পর্যন্ত এই সমস্যা থাকতে পারে। আসলে মেয়েদের জরায়ুর ‘লাইনিং’ বা আবরণ হল এন্ডোমেট্রিয়াম। কোনও মেয়ের যখন পিরিয়ড শুরু হয় তখন হরমোনের প্রভাবে জরায়ুর ভিতরে নানারকম ভাঙা-গড়া চলতে থাকে। প্রতিবার পিরিয়ডের সময় এই লাইনিং-এর সঙ্গে জরায়ুর কিছু কোশও ঝরে যায়। সাধারণত ২৮ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে এই কাজটা হয়। তবে প্রেগন্যান্ট হলে আলাদা কথা। যদিও কিছু মহিলার যোনিপথে না বেরিয়ে ওভারি, ফ্যালোপিয়ান টিউব এমনকী পেলভিসের আশপাশে এন্ডোমেট্রিয়াম লাইনিং জমা হতে থাকে। আর তার প্রাথমিক উপসর্গ হিসেবে পেট ব্যথা হলেও তা ছড়িয়ে পড়তে পারে পেলভিস এলাকায়।
শুধু তাই নয়, এন্ডোমেট্রিয়াম জমে কোষগুলো অনেকসময় সিস্টে পরিণত হয়। তখন শুধু তলপেটে নয়, প্রস্রাব, পায়খানার সময়েও ব্যথা হয়। অনেকে সহবাসের সময়েও যন্ত্রণা বোধ করে। এই সমস্যার চিকিৎসা না করে বেশিদিন ফেলে রাখলে পরবর্তীকালে বন্ধ্যাত্ব এমনকী মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। আবার এও ঠিক, কেউ কেউ কোনও সমস্যাই অনুভব করে না। তাই বেশিরভাগ সময় আনুষঙ্গিক সমস্যা যেমন পেট ব্যথা, আইবিএস (ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম) কিংবা বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের কাছে গেলে তখন পরীক্ষায় তা ধরা পড়ে।
এন্ডোমেট্রিওসিসের প্রকৃত কারণ জানা না গেলেও একটা বিষয় পরিষ্কার যে, অনেকক্ষেত্রেই এই অসুখ বংশগত। পরিবারে মা, দিদিমা কিংবা মাসির এই সমস্যা থাকলে অন্য মেয়েরও এই অসুখ হওয়ার আশঙ্কা থাকে বলে জানান বিশিষ্ট বন্ধ্যাত্ব বিশেষজ্ঞ ডা. ইন্দ্রনীল সাহা। তাই বয়ঃসন্ধিকালে পিরিয়ড শুরু হওয়ার সময় যদি প্রচণ্ড পেটে ব্যথা হয় তাহলে পেলভিক আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যান করে ওভারি ও ইউটেরাস ভালোভাবে দেখা হয়। ফলে চকলেট সিস্ট বা এন্ডোমেট্রিয়োটিক সিস্ট ওভারি না কি ভ্যাজাইনা এবং রেকটামের মাঝে আছে, তা নির্ণয় করা যায়। আর সেই বুঝে ওষুধ নাকি অপারেশনের দরকার তা ঠিক করা হয়। অন্যথায় শুধু যে যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে তা নয়, ‘আডহেশন’ অর্থাৎ জরায়ু, ওভারি ও ফ্যালোপিয়ান টিউব জড়িয়ে গিয়ে জটিলতা ডেকে আনতে পারে। অনেক সময় এন্ডোমেট্রিওসিসের জন্য টিউমার হয়। তখন একদিকে যেমন যন্ত্রণা থাকে তেমনই সন্তানধারণেও সমস্যা হয়। কাজেই রোগ নির্ণয়ের পরেই চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চিকিৎসা করা দরকার বলে জানান ডা. সাহা।
এন্ডোমেট্রিওসিসের সমস্যা বৃদ্ধির পিছনে ডায়েট ও জীবন-যাপনেরও কিছুটা ভূমিকা আছে বলে মনে করেন ডা. বিন্দ্রা। তিনি জানান প্রসেসড ফুড, চিনি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার, তৈলাক্ত খাবার, ক্যাফেইন, রেড মিট, আলকোহল ইত্যাদি যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে।
অন্যদিকে, যেসব খাবার খাওয়া দরকার তাহল প্রচুর ফল ও সবজি, ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার, স্বাস্থ্যকর ফ্যাটজাতীয় খাবার, পরিমিত পরিমাণে বাদাম। যদিও খাবারের বিষয়ে কোনও বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করে নেওয়া দরকার। কারণ শারীরিক অবস্থার ওপরে অনেকের খাদ্যতালিকা তৈরি করতে হয়। ব্যথা কমানোর জন্য কিছু পেলভিক এক্সারসাইজ করলেও উপকার পাওয়া যায়। মনে রাখতে হবে, এই অসুখটা অনেকক্ষেত্রে বংশগত বলে প্রতিরোধ করার তেমন কোনও উপায় থাকে না। তবে খাবার ও জীবন-যাপনের মাধ্যমে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।